সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১৮ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
আমি কোনো দুর্নীতি করিনি : মাদকের ডিজি শুধু মেগা প্রজেক্ট নয়, সবুজায়ন বাড়াতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা শেরপুরে কমছে নদ-নদীর পানি, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি কর্মচারী হত্যায় হাজী সেলিমসহ ৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হলো করাচি বিমানবন্দরের পাশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, নিহত ২ চীনা নাগরিক পূজায় জঙ্গি হামলার শঙ্কা নেই: আইজিপি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, পিটিআইয়ের নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা এস আলম পরিবারের ১৩ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে হত্যা মামলায় ওসি গ্রেপ্তার সিন্দুকের ভেতর শাশুড়ির মরদেহ, পুত্রবধূ আটক বাংলাদেশ রিটেইল অ্যাওয়ার্ড পেল বিকাশ ২০ বছরের ছোট সারার সঙ্গে রণবীরের রোমান্স, হতাশ নেটিজেনরা রনি হত্যা : ৩৪ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি নুর ইসলাম গ্রেপ্তার রূপালী সঞ্চয়-ঋণদান সমবায় সমিতির এমডি-ম্যানেজার গ্রেপ্তার মুক্তাকিম বিল্লাহ হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন সেতু বিভাগের সচিব হলেন ফাহিমুল ইসলাম ইসরায়েলি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ

স্বাধীনতা অর্জনে শরণার্থীদের ভূমিকা

বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক:
  • আপলোড সময় শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০২২
  • ৭৩ বার পড়া হয়েছে

৩০ লক্ষ শহীদের আত্মাহুতি এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রায় ৮ হাজার সেনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব ও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত ও রাশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতায় ৯ মাসের মধ্যেই দেশ হানাদারমুক্ত হয়।

কিন্তু আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পটভূমিতে যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার, নির্যাতনের কাহিনী আছে তার মধ্যে পিতৃপুরুষের ভিটাবাড়ি, সহায়সম্পত্তি ছেড়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যে এক কোটি শরণাথী‌র্ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অত্যাচার নির্যাতনের করুণ গাথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মনে হয় সমভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।

পাকিস্তানি জল্লাদ ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে প্রাণে বাঁচা প্রায় এক কোটি শরণাথী‌র্ ভারতে আশ্রয় নেয়। শত শত বছরের পিতৃ- পুরুষের ভিটাবাড়ি, অর্জিত সম্পদ হারিয়ে এই মানুষগুলো রাতারাতি পথে নেমে পড়ে।

তাদের অনেকের সামনে তাদের স্বামী, পিতা, সন্তান আপন জনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চোখের সামনে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত সম্পদ নিমিষেই ভস্মীভূত হয়ে যায়। স্বামীকে বেঁধে স্ত্রী ও মাকে ধর্ষণ করে, বোনকে ধরে নিয়ে যায়, জীবন্ত শিশুকে আগুনে ফেলে দেয়।

বনবাদার, নদীনালা, ঝোঁপ-ঝাড় দিয়ে ভারতে পালানোর সময় অনেক শরণাথী‌র্ দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়। অনেকের শেষ সম্বল লুণ্ঠিত হয়ে যায়। যাত্রাপথে কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারও এ ধরনের হামলার শিকার হয়। দুদিকে পাহাড়, মধ্যে খালের ওপর দিয়ে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা পাহাড় থেকে নেমে এসে আমাদের নৌকা ঘেরাও করে।

হামলাকারীরা যখন অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে নারী, শিশুসহ আমাদের জঙ্গলের দিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অনেক কাকুতি-মিনতির পর আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ ও সোনার বিনিময়ে দুবৃ‌র্ত্তরা আমাদের ছেড়ে দেয়। যাত্রাপথে বিপদ পলায়নমান মানুষের পিছু ছাড়েনি।

পাকিস্তানি বাহিনী বা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ায় পথিমধ্যে অনেককে হত্যা, লুণ্ঠন ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দাফন-কাফন পোড়ানোর অভাবে এই অভাগা মানব সন্তানের লাশ শকুন-কুকুরের আহার্য বস্তুতে পরিণত হয়, নতুবা নদীনালা দিয়ে ভেসে যেতে দেখা যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিলেট শহরের অদূরে আখালিয়া গ্রামে আমার পিসে মশাই কালীপদ ভট্টাচার্য এবং তার ছেলে আমাদের হিরুদাকে (২৯) বাড়ি থেকে পালানোর সময় দালালরা ধরে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৪ পুরুষের বিশাল বাড়ি, কয়েকটা পুকুর, ভূ-সম্পত্তি ফেলে রেখে আমার পিসীমা ১৪ বছরের মেয়ে লিলিকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পথে নেমে পড়েন।

মুহূর্তের মধ্যে এক প্রতিষ্ঠিত জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। একই এলাকার বি সি গুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানির মালিককে তার পরিবারের ১ হাজার ১১ জন সদস্যকে পালানোর প্রস্তুতির সময় পাকিস্তানি সেনারা তারাপুর চা বাগানের বাংলোর সামনে গুলি করে হত্যা করে এবং বাগানের লেবার বস্তিতে নির্বিচারে গুলি বর্ষন করে অসংখ্য শ্রমিক হত্যা কর্ে এবং কলোনিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আমার জানা মতে, সিলেটের বালাগঞ্জ থানার বুরুঙ্গা ও আদিত্যপুর গ্রামে ’৭১-এর মে মাসের দিকে দুই শতাধিক মানুষকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা গ্রাম থেকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে। স্থানীয় লোক ছাড়াও সিলেট শহর ও বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা এ মানুষেরা গ্রামে আশ্রয় নেয় ও সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করছিল।

শরণাথী‌র্ হিসেবে পালানোর পথে অথবা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে এ ধরনের কত অসহায় মানুষকে যে হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কোনো এজেন্সির নিকট সংরক্ষিত আছে কি না, সে সম্পর্কে কিছু জানা নেই।

যারা প্রাণে বেঁচে ভারতের শরণাথী‌র্ শিবিরে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল, সে সমস্ত পরিবার রাতারাতি পথের ফকির হয়ে পড়ে। তাদের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বাড়ি, পুকুর, ফসল, ব্যবসা, চাকরি হারিয়ে ছিন্নমূল এ মানুষগুলো ভারত সরকারের দয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় শরণার্থী শিবিরে, আহারের জন্যে রেশনের লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।

৮-১০ পরিবারের জন্যে একটি লেট্রিন, টাইমের পানি আর হচ্ছে কয়েক জন মিলে রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনা-—এই হচ্ছে উদ্বাস্তু মানুষদের রোজনামচা, একটাই অপেক্ষা, কবে দেশ স্বাধীন হবে। মাঝেমধ্যে পরিবারের তরুণ যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে প্রশিক্ষণে যোগদান করে। প্রসঙ্গত, শরণাথী‌র্ শিবির থেকে এক বিপুল সংখ্যক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

একটি দেশের এক সচ্ছল জনগোষ্ঠীর সর্বস্ব হারিয়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনে যতই করুণ ইতিহাস থাকুক না কেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকারের ওপর এক কোটি শরণার্থীর চাপ বিশ্বনেতাদের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে এক কোটি শরণাথী‌র্র ত্যাগ-তিতিক্ষার অন্তর্গত কাহিনী যতটুকু না জাতীয়-আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে কাভারেজ পেয়েছিল, শরণাথী‌র্র অনিঃশেষ কাফেলা, স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশুমার শরণাথী‌র্ ইসু্যর সংখ্যাগত দিক উপস্থাপন, ইত্যাদির প্রচার প্রচারণার আড়ালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এক কোটি ছিন্নমূল মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিপর্যয়ের কাহিনী অনেক ক্ষেত্রে চাপা পড়ে যায়।

অথচ এই শরণাথী‌র্ ইস্যু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বহির্বিশ্বের সক্রিয় সমর্থন লাভে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তির আনন্দে শরণাথী‌র্ পরিবারগুলো ঠিকই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসে, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে অদ্যাবধি অনেক পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

লেখক: সাবেক ডিরেক্টর, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা

বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরও সংবাদ
২০১৫-২০২৩ © বাংলা৭১নিউজ.কম কর্তৃক সকল অধিকার সংরক্ষিত।
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com