বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় এবার শীত মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের সবজির চারা বিক্রি করা হবে বলে ধারণা করছেন নার্সারি মালিকরা। প্রতিবছর তাঁরা এই এলাকা থেকে চারাগুলো বিক্রি করেন। উপজেলার চুপিনগর ও খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের আড়াই শতাধিক নার্সারিতে রোগবালাইমুক্ত, উচ্চ ফলনশীল জাতের সবজির চারা উৎপন্ন হচ্ছে। চারা তৈরির এই পল্লী থেকে উৎপন্ন সবজির চারা দেশের অন্তত ২৪টি জেলায় সরবরাহ করা হয় প্রতি মৌসুমে।
নার্সারির মালিক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চুপিনগর ইউনিয়নের শাহনগর, চক চুপিনগর, দিহিগ্রাম, বড়পাথার ও বৃ-কুষ্টিয়া, খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের খোট্টাপাড়া, জোকাসহ বেশ কিছু গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে নার্সারি। এসব নার্সারিতে কর্মসংস্থান হয়েছে এলাকার কয়েক হাজার মানুষের। অভাব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। ওই পল্লীতে গড়ে উঠেছে সার, বীজ ও কীটনাশকের দোকান।
দূর-দূরান্ত থেকে চারা কিনতে আসা মানুষের জন্য গড়ে উঠেছে খাবারের হোটেল। চারা পরিবহনে কর্মসংস্থান হয়েছে রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশাচালকদের। চলতি মৌসুমে সেখানে আড়াই শতাধিক নার্সারিতে সবজির চারা উৎপাদন করা হয়েছে। প্রতি কেজি বীজে গড়ে এক লাখ ২০ হাজার চারা উৎপন্ন হয়।
প্রতিটি নার্সারিতে গড়ে পাঁচ কেজি বীজের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। সেই হিসাবে এবার প্রায় ২০ কোটি সবজির চারা উৎপন্ন হয়েছে এ পল্লীতে। গত মৌসুমে প্রতিটি চারা গড়ে এক টাকা মূল্যে বিক্রি হয়েছিল। এবারও বাজার একই থাকলে সেই হিসাবে এ পল্লী থেকেই ২০ কোটি টাকার চারা বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিঘার পর বিঘা জমিতে পলিথিনের ছই সাজানো।
শরতের মেঘমুক্ত আকাশের রোদের ছটায় সেসব পলিথিন চিকচিক করছে। প্রতিটি জমিতেই নারী-পুরুষ কাজে ব্যস্ত। পলিথিন টাঙানো ওই সব জমিতে চাষ করা হচ্ছে সবজির চারা। কাছে গিয়ে দেখা যায়, শুধু পলিথিন টাঙানো জমিই নয়; বিশেষ ধরনের নেটে ঘেরা রয়েছে অনেক জমি। আর সেসব জমিতে প্লাস্টিকের ট্রেতে নারকেলের ছোবড়া বিছিয়ে তাতে জৈব সার ব্যবহার করে উৎপাদন করা হচ্ছে সব ধরনের সবজির চারা।নার্সারির মালিকরা জানান, বছরজুড়েই তাঁরা সবজির চারা উৎপাদন করলেও সাধারণত প্রতিবছর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেশি চারা উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে চারা নিয়ে যান। মুঠোফোনে চাহিদা পাঠিয়েও কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং বিশেষ প্যাকেটে যাত্রীবাহী বাসে অনেকে চারা সংগ্রহ করেন।
ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে উৎপন্ন চারার মধ্যে বেশির ভাগই হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা। বিজলি, বিজলি প্লাস, গ্রিন সুপার, গ্রিন মাস্টার, এনএস-১৭০১, লুবাসহ নানা জাতের হাইব্রিড মরিচের চারা উৎপাদন করা হয়েছে নার্সারিতে। এ ছাড়া রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, বেগুন ও টমেটোর চারা।
শাহনগর নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম বলেন, এবার প্রায় ২০ কোটি চারা উৎপন্ন হয়েছে। গত বছরের মূল্য ধরে এবার ১৫ কোটি টাকার চারা বিক্রি হওয়ার কথা। তবে আবহাওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে। ফলে দামও বেড়ে গিয়ে ২২ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা সমাগম কম। এ কারণে লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তাঁরা।
শাহনগর নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, বড়পাথার গ্রামের দরিদ্র কৃষক শামসুল ইসলাম আশির দশকে স্বল্প পরিসরে সবজির চারা উৎপাদন শুরু করেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে অন্যরাও চারা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিন দশকে সেখানে রীতিমতো সবজির চারা উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে।
প্রতিবছর জুনের শেষ বা জুলাইয়ের শুরু থেকে চারা বিক্রি শুরু হয়। নার্সারির বেডে বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যেই চারা বিক্রি শেষ না হলে ফুল ফুটে সেসব নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিটি নার্সারিতে এক মৌসুমেই দুই থেকে তিন দফা চারা উৎপাদন করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান জানান, প্রতিবছরের মতোই এবারও শাহনগর এলাকায় ব্যাপকভাবে চারা উৎপাদন করা হয়েছে। স্বল্পমূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন চারা পাওয়ায় প্রতিবছর এখানকার চারার চাহিদা বাড়ছে।
প্রতিকূল আবহাওয়ায় চারা উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য পলিথিনের ছাউনিতে নার্সারির বেডগুলো ঢেকে দেওয়া হয়। চারা উৎপাদনে সম্পৃক্ত নার্সারি মালিকদের কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি ওই এলাকায় নিয়মিত মাঠ দিবস পালন করা হয় বলেও জানান তিনি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ