মোস্তফা মামুন বলতে দ্বিধা করলেন না। একবার নয়। দুইবার বললেন। দৈনিক দেশ রূপান্তরের সম্পাদক মামুন অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘সবাইকে মাথায় রেখে বলছি, অঘোর মন্ডল হচ্ছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেট রিপোর্টার। কেউ তার চেয়ে ভালো লেখক হতে পারেন। কেউ তার চেয়ে ভালো বক্তা হতে পারেন। কেউ তার চেয়ে বড় বিশ্লেষক হতে পারেন। কিন্তু তার চেয়ে বড় রিপোর্টার কেউ ছিলেন না।’
মামুনের এই ঘোষণা আসল এমন দিনে যেদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ক্রীড়া জগতের কিংবদন্তি সাংবাদিক অঘোর মন্ডল পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি কিডনি ও হৃদরোগসহ নানারকম শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ডায়ালাইসিস চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি সমস্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও গত ৫ সেপ্টেম্বর আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইফসাপোর্টে রাখা হয় তাকে। সেখানেই গতকাল বিকেলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাত আটটায় তাকে নিয়ে আসা হয় জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে। যেখানে তাকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় চিরবিদায় জানান খেলোয়াড়, সংগঠক এবং সহকর্মীরা। শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপনের আগে মোস্তাফা মামুন বলেছেন, ‘রিপোর্টারদের জন্য যদি কোনো কোচিং ম্যানুয়াল লাগে তাহলে অঘোর দা’র জীবনটাই কোচিং ম্যানুয়াল। কেউ যদি বড় রিপোর্টার হতে চায় তাহলে তাকে অঘোর দাকে অনুসরণ করতে হবে। জানতে হবে সে কিভাবে নিজেকে তৈরি করেছে।’
প্রায় একই রকম কথা বলেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এটিএম সাইদুজ্জামান, ‘আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন থেকেই তিনি আমার শিক্ষক। আমার রিপোর্টিং জীবনের শুরুটা তার অভিভাবকত্ব দিয়ে। চাপ দিতেন কাজ বের করে নিতে। তিনি আমার শিক্ষক, তিনি আমার বন্ধু। তার সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেসবক্স শেয়ার করেছি। এটা আমার জীবনের পরম পাওয়া। আমি বলতে চাই, তার পরিবারের সদস্যদের গর্ব করা উচিত যে, তার মতো একজনকে পরিবারের সদস্য হিসেবে পেয়েছে। তাকে সৃষ্টিকর্তা নিয়ে গেছেন। নিশ্চয়ই তাকে ভালো রাখবেন।’
ক্রিকেট সংগঠক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি বলেছেন, ‘আমাদের ক্রিকেট বোর্ড বা অন্যান্য ফেডারেশনে বিভিন্ন পরিস্থিতি বা ক্রিটিকাল সময়ে অঘোর মন্ডলের কাছ থেকে আমরা পরামর্শ চেয়েছি। ওই অবস্থা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। উনি আমাদেরকে নিরপেক্ষভাবে সেই পরামর্শগুলো দিয়েছেন। তাতে আমাদেরই ভালো হয়েছে। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সম্পর্ক ছিল গাঢ়। আমাদের এখন কথা শেয়ার করা, কথা বলার লোকও কমে যাচ্ছে। সেই তালিকা থেকে আরো একটি নাম কাটা পড়ল। পরপারে ভালো থাকবেন অঘোর দা।’
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক বলেছেন, ‘ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন আমার ক্রীড়া বিষয়ক যেকোনো তথ্য, উপাত্ত বা কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। দাদা নির্দ্বিধায়, নিসংকোচে আমার সঙ্গে বসে বসতেন কথা বলতেন। এখন যখন পরিবর্তনের সময়, অনেক দিকনির্দেশনা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে ঠিক করতে পারতেন, তখনই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।’
অঘোর মন্ডল তিন দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে ভোরের কাগজে ছিলেন। বর্তমানে দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক ক্রীড়া সাংবাদিকের হাতেখড়ি হয়েছে তার মাধ্যমে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সম্প্রচারে মাধ্যমে যোগ দেন তিনি। চ্যানেল আই, দীপ্ত টিভি, এটিএন নিউজে কাজ করছেন দীর্ঘদিন।
অঘোর মন্ডলের মৃত্যুতে পৃথক পৃথক শোক বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএসজেএ), বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিসহ আরও অনেক সংগঠন। রাতে অঘোর মন্ডলকে পোস্তাগোলা শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের পালাবদলের ইতিহাস দেখেছেন, লিখেছেন অঘোর মন্ডল। অনেক ক্রিকেটারের অজানাকে তিনি তুলে এনেছেন কলমের ছোঁয়ায়। পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে। সেকালের আকরাম, বুলবুল, নান্নু, দূর্জয়দের যেমন কাছ থেকে দেখেছেন, এই সময়ের সাকিব, মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, আশরাফুলদের পথ চলায়ও সঙ্গী হয়েছেন।
বর্তমান সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া সাংবাদিক তার হাতে গড়া। প্রায় প্রত্যেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অঘোর মন্ডলের প্রতি ভালোবাসা উগড়ে দিচ্ছেন। যেখানে অকালে তাকে হারানোর শোক ফুটে উঠেছে শত-সহস্র শব্দে, অযুত-নিযুত আবেগে।
জীবনের শেষ লিখাটা লিখেছিলেন কলকাতার গণমাধ্যম আনন্দবাজারে, ২৭ আগস্ট। ডায়ালাইসিস চিকিৎসার সময়ে শরীর একটু ভালো বোধ করায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মোবাইলে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ জনতার মনেও শাকিবের জন্য ফুল ও কাঁটা।’ এরপর আর কোনোদিন কলম ধরা হয়নি তার। চিরজীবনের জন্য টেনে দিলেন ‘দাঁড়ি।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ