ভালবাসা মানেই লাল গোলাপ। এই ছবি আমাদের মনে একেবারে গেঁথে আছে। আবার যদি শান্তি, পবিত্রতার কথা আসে, তবে অবধারিত সাদা ফুলই বেছে নিই আমরা। অর্থাৎ এক-একটা অনুভূতি জানাতে এক একরকমের ফুল হাতে তুলে নেওয়াই রীতি আমাদের। আর এইভাবেই মুখে একটা কথা না বললেও, মনের সব কথাই বলে দিতে পারে ফুল। কিন্তু তাহলে তো বলতে হয়, ফুলেরও নিজস্ব ভাষা আছে! আছে বইকি! ফুলের ভাষায় মানুষের কথা বলা, বা কমিউনিকেট করার চলও বহুদিনের। আসুন, আজ সে ব্যাপারে বিস্তারিত শুনে নিই।
পোশাকি নাম ‘ফ্লোরিওগ্রাফি’। আমরা তাকে বলি ফুলের ভাষা। সে ভাষায় ফুলেরা যে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, এমনটা নয়। আসলে মানুষের কথা বলার যেমন অনেক ভাষা, তেমনই একটি ভাষা হয়ে ওঠে ফুল। আর এর সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাস, রূপকথার অনেক গল্প। সব মিলিয়েমিশিয়েই তৈরি হয়েছে এই ফ্লোরিওগ্রাফি।
যেমন, যদি চাঁপা আর পারুলের কথা বলা হয়, তাহলে যে কোনও বাঙালিরই মনে পড়বে সাত ভাই চম্পা আর তার পারুল বোনের গল্প। একটা রূপকথার গল্পকে যখন ফুল দিয়ে প্রকাশ করা হয়, তখন সেই ফুলের গায়ে লেগে থাকে রূপকথার বার্তাটিও। ঠিক এইভাবেই বহু ফুলই মানুষের অনুভূতির বাহক হয়েছে। ক্রমে জন্ম নিয়েছে ফুলের ভাষা। শব্দহীন এই ভাষা বেশ প্রাচীনও বটে। সম্ভবত সেই বৃক্ষপূজার সময়কাল থেকেই অনুভূতি বা বার্তা প্রকাশের প্রতীকী অর্থে গাছ এবং ফুলকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ধরুন তুলসী গাছ। আয়ুর্বেদিক মাহাত্ম্য সরিয়ে রাখলে একরকমের এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধর্মীয় অনুষঙ্গও দেখা যায়। তুলসী গাছকে হিন্দু ভক্তেরা পূজা করেন। নারায়ণের কাছে অর্পণ করা হয় তুলসীকে। কেননা এই গাছের সঙ্গে মিশে গিয়েছে দেবী তুলসীর পৌরাণিক কাহিনি।
এইভাবে পৌরাণিক, লোকায়ত কাহিনি বা রূপকথার কাহিনি সংযুক্ত হয়ে গাছ এবং ফুলকে আলাদা আলাদা অর্থ দিয়েছে। পাশ্চাত্যের দিকে চোখ মেললেও এমন উদাহরণ দেখা যায়। ধরুন, সেই নার্সিসাস নামে ব্যক্তির কথা। কাল্পনিক চরিত্র। তাঁর সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তিনি এমন মোহিত হয়ে যান যে তিনি নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যান। সেখানেই একদিন তার মৃত্যু ঘটে। আর সেই জায়গায় ফুটে ওঠে একরকম ফুল। যা পরিচিতি হয় নার্সিসাস ফুল নামে, ড্যাফোডিল বলে যাকে সকলেই চেনেন। এই ফুলকে তাই প্রেম, স্নেহ প্রভৃতির প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। এইভাবেই আসলে বিস্তার লাভ করেছে ফুলের ভাষা। ভিক্টোরিয়ান যুগে এই ফুলের ভাষা তৈরির ক্ষেত্রে মেতেছিল মানুষ। ফুল সহযোগে কোনও অনুভূতি প্রকাশের রীতিকে অনেকেই ভিক্টোরিয়ান এটিকেট হিসাবে দেখেন। আজও শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানাতে সেই ফুলেরই দ্বারস্থ হই আমরা।
এই যেমন প্রেমের মৌসুমে রাজত্ব করছে লাল গোলাপ। অর্থাৎ ভালবাসার কথা মুখে না বলতে পারলেও, স্রেফ একটা ফুলই সে কথা বলে দিতে পারে। লাল গোলাপকে প্রেম ও প্যাশনের প্রতীক হিসাবেই দেখা হয়। একান্ত ভালবাসার মানুষকেই তাই লাল গোলাপ দেওয়া যায়। আবার এর সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসঙ্গও জড়িয়ে আছে। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্তক্ষরণে গোলাপ হয়েছে লাল, এমন বিশ্বাসও আছে। গোলাপের কাঁটা হচ্ছে সেই ক্ষতের প্রতীক। খ্রিস্টমাস ইভেও তাই লাল গোলাপ দিয়ে চারিদিক সাজানোর রীতি আছে। আবার যদি প্রেমের গভীরতা থেকে সরে এসে বন্ধুত্বের গাঢ়তার কথা বলতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবে হলুদ গোলাপ বা হলুদ ফুল। পিঙ্ক বা গোলাপি রঙের ফুল আবার আনন্দের আয়োজন সম্পূর্ণ করে। কেউ একে বিশ্বাসের প্রতীক হিসাবে দেখে, কোথাও আবার একে দেখা হয় সৌভাগ্য বা সুস্বাস্থ্যের প্রতীক হিসাবে। আবার গোলাপি রংটিকে নারীদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার রীতিও আছে, গোলাপি ফুল সেই বার্তাও বহন করে। সাদা ফুল আবার শোক, এবং শান্তির কথা বলে।.আসলে কেউ যখন আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে যান, তখন আমরা আমাদের জীবন থেকেই তাকে হারিয়ে ফেলি। এই যে হারিয়ে ফেলা, এই কথাটুকু জানান দেয় সাদা ফুল। ফুলের ভাষার তাই মাহাত্ম্য দেখুন, আপনি যদি কাউকে মিস করেন, একটা সাদা গোলাপ কিন্তু সেই কথাটিই বলে দেবে।
ফুলের ভাষার আবার আরও পরত আছে। কীভাবে ফুল দেওয়া হচ্ছে তার উপরও অনুভূতির প্রকাশ নির্ভর করে। যেমন ধরুন, লাল গোলাপ ভালবাসার প্রতীক। কিন্তু সেই ফুলটিই যদি নিচের দিকে করে দেওয়া হয়, অর্থাৎ ফুলের পাপড়িরা যদি নিচে থাকে, তবে বুঝতে হবে তা ভালবাসা প্রকাশ করছে না মোটেই। বরং ভালবাসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানেরই চিহ্ন এটি। এইভাবে ফুলের সজ্জা থেকে রিবনের বাঁধন – এক একরকমের অর্থ নিয়ে ধরা দেয়।
মুখের কথার মতোই প্রাচীন এই ফুলের ভাষা। অনেক শব্দে যা প্রকাশ করা যায় না, একটা ফুলই সে কথা জানিয়ে দেয়। ফুলের ভাষা জানা থাকলে তাই নিজেকেই হয়তো প্রকাশ করা যায় আর একটু ভালো করে।
বাংলা৭১নিউজ/বিআর