দেখতে দেখতে মিরসরাই ট্র্যাজেডির ১২ বছর পার হয়ে গেলো। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন নিহতদের স্বজনরা। এখনো আসা-যাওয়ার পথে দুর্ঘটনাস্থলে থমকে দাঁড়ায় পথিক।
মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ফুলেল শ্রদ্ধায় মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্বরণ করলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্বজন, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সকালে দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’ ও আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের মূল ফটকে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’-এ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এসময় নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ভয়াল মিরসরাই ট্রাজেডিতে নিহত অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমিন শরীফের বাবা শাহজাহান বলেন, আমার ছেলে যখন মারা যায় আমি তখন বিদেশে ছিলাম। শেষ সময়ে ছেলেটাকে আমি দেখিনি। এর চেয়ে কষ্টের আমার কাছে আর কিছুই নেই।
তিনি বলেন, আমার ছেলেসহ ৪৫ জন যেখানে নিহত হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে ‘অন্তিম’ নামের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যখনই ইকোনোমিক জোনের রোড দিয়ে যাতায়াত করি, স্মৃতিস্তম্ভটা নজরে পড়ে। কষ্টে তখন বুকটা ফেটে যেতে চায়।
মঙ্গলবার সকালে শ্রদ্ধা জানান গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এরপর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা আওয়ামী লীগ, আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শ্রমিক লীগ, মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদ, মঘাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা যুবলীগ, মায়ানী ইউনিয়ন ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্যোগে শোকসভার আয়োজন করা হয়। মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহমদ নিজামীর সঞ্চালনায় ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আবুল হোসেন বাবুলের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার।
স্বাগত বক্তব্যে প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার বলেন, মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে যেসব শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে তাদের স্মরণে ১১ জুলাইকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা উচিত। নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে।
মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে সবচেয়ে বেশি নিহত হওয়া আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার ঘোষণার বাস্তবায়ন চান তিনি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বিআরটিসি বাস দেওয়ার দাবি জানান প্রধান শিক্ষক।
নিহত শিক্ষার্থী আশরাফ উদ্দিনের বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, ছেলে হারানোর শোক এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ নির্মাণ করার সময় আমি স্বেচ্ছায় শ্রম দিই। প্রতিদিন বাজারে আসলে স্মৃতিস্তম্ভে থাকা ছবিতে হাত বুলিয়ে যাই। প্রতিনিয়ত মনে হয় আদরের সন্তানটি বাড়ি ফিরবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, মিরসরাই ট্র্যাজেডি স্মরণকালের ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনা। এইদিন পিকআপ উল্টে ৪২ শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জনের মৃত্যু হয়। যারা জীবিত থাকলে পরিবার, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতো। আমি তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ট্র্যাজেডিতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী নিহত হওয়া আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ, আসবাবপত্রসহ যেসব সংকট আছে তা নিরসন করা হবে। নতুন একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।
২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা শেষে ফেরার সময় শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি পিকআপ বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় পাশের একটি ডোবায় উল্টে যায়। যেখানে উপজেলার আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারজন, আবুতোরাব ফাজিল মাদরাসার দুইজন, প্রফেসর কামালউদ্দিন চৌধুরী কলেজের দুইজন শিক্ষার্থী নিহত হয়। এছাড়া এক অভিভাবক, দুইজন ফুটবলপ্রেমী যুবকসহ ৪৫ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি।
নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের মূল ফটকে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’।
বাংলা৭১নিউজ/এসএস