মালয়েশিয়া ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ শুরু করলেও ২০১৫ সালে ‘লেবার সোর্স’ দেশের মর্যাদা পায়। ততদিনে বাংলাদেশি কর্মী আরও বেড়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রবাসীর সংখ্যা বাড়ে। সব মিলিয়ে ১৫ লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছে। আরও এসব কর্মীদের ঘিরেই বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় রয়েছে নানান চক্র ও অপকর্ম।
এসব চক্রের কারণে শুধু বাংলাদেশের শ্রম বাজারের ক্ষতি হয়েছে এমন নয় মালয়েশিয়ার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে এবং এখনও জবাবদিহি করতে হচ্ছে।
সাধারণত উভয় দেশের কপালে জুটেছে মানবপাচার, শ্রম শোষণ, হয়রানি, প্রতারণা আর জোর জবরদস্তি শ্রমের অভিযোগ। নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও যৌক্তিক অভিবাসন করার আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটে সই করলেও সেসব লক্ষ্য অর্জন না করার অভিযোগ বেশ পুরোনো।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলেও এদের ও নিয়োগকর্তার মাঝখানে অবৈধ কিছু ব্যক্তি আছে যাদের দালাল বাটপার বা মিডল ম্যান বলা হয় তাদের চক্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ায় সাধারণত কর্মীদের আটকে রাখা, পাসপোর্ট আটকে রাখা, অবৈধ করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া, আবার ছড়িয়ে আনা, কোম্পানি থেকে ফুসলিয়ে লোভ দেখিয়ে পালিয়ে নেওয়া এবং অবৈধ করে বৈধতার নামে অর্থ নেওয়া, পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার নামে অর্থ নেওয়া ঘটনা যেন ডালভাত।
এছাড়াও নকল কাগজপত্র করে চাহিদার অতিরিক্তকর্মী বাংলাদেশ থেকে এনে মালয়েশিয়ায় ডাম্পিং করার ঘটনা ঘটেছে বারবার। সর্বশেষ ২০০৬/০৭ সালে অতিরিক্ত কর্মী এনে মালয়েশিয়ায় মানবিক বিপর্যয় করা হয়েছে। ২০২৩/২৪ সালেও যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ফলে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া সরকার। এতে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হয়েছে।
এর আগে আউট সোর্সিং পদ্ধতিতে ব্যাপক অনিয়ম, শ্রম শোষণ, আটকে রাখা, বেতন ঠিকমতো না দেওয়া, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া এবং নিয়োগকর্তাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বাজে ঘটনার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে আউট সোর্সিং নিষিদ্ধ করে।
ইদানিং কিছু গ্রুপ আবিষ্কার হয়েছে যারা নিরীহ প্রবাসীটিকে দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বা অভিনয় করিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হিরোগিরি দেখিয়ে সাজানো অনিয়ম তুলে ধরে, ফলে সামান্য স্বার্থের জন্য বিশাল স্বার্থ জলাঞ্জলিতে গেছে। আরও আছে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি এবং মালয়েশিয়ায় দালালদের নানান প্রতিযোগিতা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালকে খারাপ প্রমাণ করতে গিয়ে নানান অপকর্ম করে থাকে। যা শেষকালে বাংলাদেশেরই বদনাম হয়। এদের নেই কোনো লাগাম, নেই কোনো জবাবদিহিতা।
এরা কোনো চাকরি করে না শতভাগ দালালি করে অর্থ উপার্জন করে ধনী হয়েছে যা অন্যদেরও উৎসাহিত করে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দালালের আবির্ভাব ঘটছে। অনেকে বিভিন্ন পেশার বেশ ধরে অর্থাৎ মানব হিতৈষী, মানবাধিকারকর্মী ইত্যাদি আড়ালে দালালি করে বেশ অর্থ উপার্জন করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রবাসী জানিয়েছেন, এবারের শ্রমবাজারে প্রায় ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি মিডলম্যান রয়েছে যারা দেশটিতে কর্মী কিনছে আর বিক্রি করছে। শ্রমিক লেনাদেনার ফলে, তারা যে যেভাবে পারছে, সে সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছে।
কৌশল হিসেবে এরা একদিকে সরকার তথা হাইকমিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে নিজেদের বিশ্বস্ত করে তোলে। অন্যদিকে বেশি বেতনে কাজ পাইয়ে দেওয়ার টোপ তথা পুলিশ ও ইমিগ্রেশনের হাত থেকে বাঁচাতে বৈধ করার বিশেষ অফার দিয়ে আকর্ষিত করে।
নিত্যনতুন এসব দালালি ডোজে দিশেহারা হয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিকরা বলছে, নতুন পুরাতন কর্মীরা কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। নানা রকম পাঙ্কাট ওয়ালা উচ্চ পদবির দাতো, দাতোশ্রী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের সাথে যোগসাজশে ব্যাকআপের পরিচয় আর ভয়ভীতিতে সাধারণ কর্মীরা বাধ্য হচ্ছে এ চক্রের কথামতো চলতে।
বৈধ হওয়ার আশায় অনেকেই তাদের প্ররোচনায় বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বৈধতা না পেয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে তারা। পরে এসব টাকা চাইতে গেলেই উল্টো পুলিশ দিয়ে অথবা লোকাল গ্যাংস্টার দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে তাদের।
এদের দৌরাত্ম হয়েছে বন্ড সিরিজের মতো। হয়রানি ও কিডন্যাপ থেকে শুরু করে মার্ডার করতেও পিছপা হয় না তারা। দ্বিধা করছে না, নারী ব্যবসা থেকে শুরু করে চাইল্ড পর্নোগ্রাফিরমতো বিকৃত রুচির কালোবাজারিতেও জড়াতে।
এসব দালালদের তথ্য উপাত্ত ঘেটে জানা গেছে, এরা বাংলাদেশেরই মানুষ! এরাও একদিন সাধারণ শ্রমিক বেশে মালয়েশিয়ায় এসেছে। দীর্ঘদিন মলেয়শিয়ায় বসবাস করার ফলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে, এমনকি পুলিশের সঙ্গে এবং বিদেশি মদদ পুষ্ট এনজিওদের সাথে অনৈতিক সোর্স হিসেবে গড়ে উঠেছে তারা। ফলে তাদের সাথেই যোগসাজশে দেশি-বিদেশি চক্রের ক্রীড়ানকে পরিণত করছে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি শ্রমবাজার।
এদের মধ্যে এমন আট জন ভিক্টিমের তথ্য উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে মো. আব্দুল আলিম, মো. আল-আমিন, মো. রানা, মো. কেসমত আলী, মো. রাকিব উল্লাহ, মো. শফিকুল ইসলাম ও মো. ইব্রাহীম। যারা এই প্রতারক চক্রের প্ররোচনায় তাদের নিজের কোম্পানির বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় পুলিশ রিপোর্ট করে।
অথচ সরেজমিনে তাদের নথি পত্র ঘেটে জানা গেছে, কোম্পানি তাদের কাজ দিয়েছে এবং সেই কোম্পানি বেসিক বেতনের পাশাপাশি ওভার টাইমও দিয়েছে যার পরিমাণ দৈনিক তিন থেকে চার ঘণ্টা প্রায়। পরে কোম্পানি ও শ্রমিকদের মুখোমুখি বসিয়ে তাদের দেওয়া বেতনের এসব নথিপত্র দেখানো হলে, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে কোম্পানির নামে করা পুলিশ রিপোর্ট তুলে নিয়েছে।
সরেজমিনে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মীদের সবরকম সুবিধা দিতে কোম্পানিটি তৎপর। এদের মধ্যে এক শ্রমিক জানিয়েছে, আমাদের বস বলেছে তোমাদের কেউ যদি কাজ না পেয়ে থাকে বা কাজের সুরাত নিয়ে অন্য যায়গায় কাজ করছে এমন কেউ থাকলে তাদের চলে আসতে বলো।
কথার মধ্যে আরেকজন শ্রমিক বললেন আরেক কথা, আমাদের বলেছে ওখানে গেলে টাকা পাওয়া যাবে এবং নানান সুবিধার কথা বলেছে তারপর আমরা সেখানে গিয়েছি।
কেন গেলেন, কীভাবে গেলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে- আরেক কর্মী বলেন, কোম্পানি থেকে বলা হয়েছে তোমাদের মেডিকেল এবং ভিসা কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তোমাদের কাজে নেওয়া হবে। এর মাধ্য আমাদের কাজের ব্যবস্থা হয়নি।
আমি ধারদেনা করে আসছিলাম। এর মাঝে তাদের সাথেরই একজন জহিরুল বলে, জেটিকেতে মামলা করলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। তখন জহিরুল আবু সাইদের সাথে মিশে আমাদের আটজনকে নিয়ে মামলা করালো। মামলাতে অনেক মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। তারা আমাদের সব শিখিয়ে দিয়েছে। আমরা আমাদের স্বার্থের জন্য মামলা করেছি।
এই শ্রমিক আরও জানিয়েছে, আবু সাইদ বলে যত লোক বেশি হবে মামলা তত ভারি হবে। সে সময় জহুর বাহরুতে একটা নিউজ ভাইরাল হয়েছিল। তখন আরও বেশি আমাদের মনে দাগ কাটে। যারা কাজে ছিল এবং বেকার ছিল সবাইকে ডেকে আনা হয়। আসলে তাদের সবাইকে যাতায়াত খরচ দেবে। তাদের মিথ্যা কথা বলে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের যে ফর্মে সাইন করানো হয়েছিল। অনেকে পড়তে পারে না আবার সেটা মালয় ভাষায় ছিল।
সে আরও জানিয়েছে, কোম্পানির মালিক জানতে পারে তার প্রজেক্টে কাজ করে বেতন নিয়ে তার বিরুদ্বেই মামলা করেছে। প্রত্যেকের কাছেই বেতনের রিসিট ছিল। তারা ২৮০০ থেকে ৩০০০ রিঙ্গিত সেলারি পায়। এরপরেও তাদের এমনভাবে স্বপ্ন দেখিয়েছে তারা মামলা করতে বাধ্য হয়।
যারা কাজ পেয়েও কোম্পানির বিরুদ্বে মামলা করেছে তাদের সমস্ত প্রমাণ কোম্পানির কাছে রয়েছে। আমাদের কয়েকজনের তখন কাজ ছিল না, বাকি সবাই কাজে ছিল। বস যখন বেতনের স্লিপ দেখতে পায়, তখন সবাই বলে জহুরুল আমাদের প্ররোচনা দিয়েছে। আমরা সবাই বসের কাছে ক্ষমা চাই।
এদের মধ্যে আরেকজন কর্মী বলেন, আবু সাইদ আমাকে বলেছে, তোমাকে কোম্পানি পরিবর্তন করে দেবো অন্য যায়গায় থাকলে টাকা পাবে। আমরা মালাক্কাতে ছিলাম। যাতায়াতের জন্য ৬০০ রিঙ্গিত দেয়। আমরা যে জেটিকেতে আসতেছি যেটা আমাদের জানানো হয়নি, আমরা জানতাম কুয়ালালামপুর চৌকিটে আসছি।
যখন টিবিএসে আসলাম তখন লোকেশন দিলো, আমরা চিনি না। আইসা দেখি এটা জেটিকে। তখন আমাদের একটা পেপারে সাইন নিয়েছে। তারা বলেছে আমরা যদি মামালায় জয়ী হই তাহলে তোমরা টাকা পয়সা পাবে। তবে কে টাকা দেবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলেনি।
এদিকে আবু সাইদ তাদের ফোনে হুমকি দিয়ে বলেন, আপনারা যদি এই কথা কোথাও শেয়ার করেন তাহলে আপনারা সমস্যায় পড়বেন। আপনাদের কোনো ব্যাকআপ নেই। আমি কিন্তু ব্যাকআপ নিয়ে চলি।
এসব অনিয়মের এবং প্রবঞ্চনার শুরু কিছুটা বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয়। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বাংলাদেশের প্রান্তে রিক্রুটমেন্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নির্ভর করে। এই এজেন্সিনির্ভর করে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা অধরা দালালদের ওপর।
তখনই কাজ ও বেতন সম্পর্কে যেসব লোভনীয় কথা শোনানো হয় সে সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় এবং মালয়েশিয়ায় আসার পর কর্মীরা নিজেদের কোনো দালালের খপ্পরে আবিষ্কার করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের দালাল ও মালয়েশিয়ায় দালালের মধ্যে যোগাযোগ মানে কেনাবেচা আছে। মানুষটি যেন পণ্য হয় সরকারি সব ব্যবস্থার মধ্যেই!
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি দালাল বা রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কোম্পানি বা কোম্পানির এজেন্টের কাছ থেকে ভিসা কিনে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চালু রয়েছে। এর করুণ অবস্থা দেখা গেছে জি টু জি প্লাসের সময় তখন দশটি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির অনুমতি থাকলেও বাস্তবে আগেই বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির ভিসা কিনে নেওয়ার চিত্র ফুটে ওঠে।
তখন আগেই কোম্পানির থেকে ভিসা কিনে রাখা রিক্রুটিং এজেন্সি বাধ্য হয়ে নির্ধারিত দশটি এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে। ফলে জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ভিসা কিনে নেওয়া এজেন্সিগুলো বেশ সোচ্চার হয় এমন কি উচ্চ আদালোতে মামলাও করে।
দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম ও অনিয়ম যেন বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বাঁধা হয়ে আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম ও অনিয়ম দুটোই সরকারি আশ্রয়ে প্রশয়ে বেড়ে ওঠে। তাই সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে এক সময় মালয়েশিয়া বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের কর্মী নেওয়ার বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু দালালরা এসব জেনে বুঝেই যে কোনো উপায়ে দ্রুত অর্থ আয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে আর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ