কোনো জাতিকে সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত করে তোলার জন্য প্রথম যে উপাদান প্রয়োজন, তা হলো শিক্ষিত জনসমাজ। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড; বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের সর্বোত্তম হাতিয়ার। শিক্ষা হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোকিত করে এবং কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। প্রিয় নবী (সা.) মানুষকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পৃথিবীতে খনিজ পদার্থের মধ্যে স্বর্ণ ও রুপার মূল্য সবচেয়ে বেশি।
অনুরূপভাবে সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে ওই মানুষ বেশি মর্যাদাবান যদি সে দ্বিনি জ্ঞান লাভ করে। এমনকি সেই মর্যাদাবান মানুষের কারণে পুরো সমাজ আলোকিত হয়। হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সোনা-রুপার খনির মতো মানবজাতিও খনিবিশেষ।
যারা জাহিলিয়াতের (অন্ধকারের) যুগে উত্তম ছিল, দ্বিনের জ্ঞান লাভ করার কারণে তারা ইসলামের যুগেও উত্তম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩৮৩)
পৃথিবীতে মানবসমাজের ভিত্তি সূচিত হয়েছিল আদম (আ.)-এর মাধ্যমে। কালের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে অসংখ্য নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। ওই নবী ও রাসুলদের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে জ্ঞান পৌঁছেছে।
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের দ্বারা পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। এই বিকশিত বুদ্ধি দিয়ে মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে এবং গবেষণা করে নতুন নতুন রহস্যের দ্বার উন্মোচন করে। এভাবেই জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে পৃথিবী সমৃদ্ধ হয়। মানুষের জীবন পরিচালনার পদ্ধতি দিন দিন সহজ হয়।
নবী-রাসুলের আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মদ (সা.)।
তিনি জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জাতিকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠতম জাতিতে পরিণত করেছেন ঈমান ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। রাসুলুল্লাহ (সা.) হেরা পর্বতের চূড়ায় মহান আল্লাহর ধ্যানে গভীর মোরাকাবায় নিমগ্ন থাকাকালীন জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে ওহির সূচনা হয়। আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত ওহির জ্ঞান পৃথিবীর সব জ্ঞানের মূল।
ইসলামে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব অত্যধিক। যারা জ্ঞান চর্চায় জড়িত, তাদের মর্যাদাও আকাশছোঁয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন প্রহরে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে তা করে না? বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তিন প্রকার মানুষের জন্য ফিতনা ও অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকার সুসংবাদ দিয়েছেন। এই তিন ধরনের মানুষ হলো আল্লাহর জিকিরকারী, আলেম ও ইলমে দ্বিনের শিক্ষার্থী। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পৃথিবী অভিশপ্ত এবং অভিশপ্ত তার মধ্যকার সব বস্তু। তবে আল্লাহর জিকির ও তার আনুষঙ্গিক বিষয় এবং আলেম (দ্বিনি শিক্ষক) ও তালেবে ইলম (দ্বিনি শিক্ষার্থী) ছাড়া।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩২২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানার্জনের কাজকে ফরজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ জ্ঞানার্জন ছাড়া জাগতিক সম্পদের আধিক্য কোনো কাজে আসে না। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ইলম শিক্ষা করা ফরজ।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস : ২২৪)
জ্ঞান মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির সোপান। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের উপায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘করুণাময় আল্লাহ। শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা।’ (সুরা : আর রাহমান, আয়াত : ১-৪)
জ্ঞানার্জনের কাজ এত মহৎ যে এর সহযোগিতাকারী মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব লাভ করে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে—সদকায়ে জারিয়া (যেমন—মসজিদ, মাদরাসা ও জনকল্যানমূলক প্রতিষ্ঠান), এমন ইলম যার দ্বারা লোকেরা উপকৃত হয়। (যেমন—ছাত্র রেখে গিয়ে এলমে দ্বিনের চর্চা অব্যাহত রাখা বা কোনো কিতাব লিখে যাওয়া), নেককার সন্তান, যে তার পিতার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৬৩১)
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ