ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) বেলা সোয়া ১১টায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর একদিন আগেই তিনি দিল্লী গেলেন।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আজ বিকেলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকটি হবে নয়াদিল্লির ৭ নম্বর লোককল্যাণ মার্গে নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে। দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের এ বৈঠকে বহুল আলোচিত তিস্তা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাসহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাবে বলে ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, বিকেলে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে দুদেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে বাংলাদেশের হাঁড়িভাঙা জাতের আমের চারা রোপণ করবেন। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর বিকেলে তিনি ঢাকায় ফিরবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সরকার প্রধানের দিল্লি সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান, দুদেশের মধ্যে আজ কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি বিনিময় চুক্তির মেয়াদ ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনপিসিআইর মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। ভারতের এনপিসিআই ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হলে দুপক্ষের মধ্যে নেটওয়ার্ক-টু-নেটওয়ার্ক সংযোগের মাধ্যমে রুপি-টাকায় পারস্পরিক লেনদেনের কাজ সহজ হবে। এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বিদ্যুৎ ও রেলপথের একাধিক প্রকল্পের উদ্বোধন হতে পারে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দুদেশের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ও বহুমাত্রিক যে, এক দেশের ঘটনাপ্রবাহ অন্য দেশে প্রভাব ফেলে। সরকারের প্রতি সন্ত্রাস দমন ও নিরাপত্তাসহ নানা কারণে কৃতজ্ঞ ও আস্থা রাখে বন্ধু দেশটি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এখন আঞ্চলিক কানেকটিভিটি ও বাণিজ্যের বড় কেন্দ্র হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া কানেকটিভিটি, সমুদ্র অর্থনীতি ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতিতেও ঢাকাকে দিল্লি পাশে চায় বলে আলোচনা রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের তিন মাসেরও কম সময় বাকি। সংবিধান সম্মত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসা নীতিসহ নানাভাবে সরকার চাপে রয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিও শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলছে। ভারতেও আগামী বছরের প্রথম ভাগে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এমন বাস্তবতায় হাসিনা-মোদির বৈঠকে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কী কথা হবে—তা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা।
এমন বাস্তবতার নিরিখে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দুই নেতার বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে কি না, জানি না। আমরা যেটি চাই, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য। আমরা কোনো কারচুপি চাই না। আমরা স্বচ্ছ ও সুন্দর নির্বাচন চাই। সেখানে কেউ যদি আমাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে কেউ যদি মাতব্বরির ভূমিকা নিয়ে আসে, আমরা সেটি সহ্য করব না। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কাউকে ভয় পায় না। আমরা কোনো চাপের মুখেও নেই। কারণ আমরা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, সুন্দর একটি নির্বাচন করব। অন্যরা পছন্দ করুক বা না করুক, এটি তাদের সমস্যা।
সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সংগঠন জি-২০’-এর সভাপতি ভারত বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ সম্মান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, বিভিন্ন সময়ে পারস্পরিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমমনা অবস্থান দুই দেশের সম্পর্ককে গভীরতর করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে দুই দেশের সম্পর্ক অভাবনীয় গতি লাভ করেছে, যা সোনালি অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে অন্যতম বন্ধুপ্রতিম এবং সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে বলেই জি-২০ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র অতিথি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ করেছে।
জি-২০ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কী পাবে—জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জি-২০-এর সদস্যরা বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ, বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ এবং বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ইস্যুতে বৈশ্বিক কাঠামো গঠন ও শক্তিশালীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিদ্যমান অনন্য সম্পর্কের ভিত্তিতে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে জি-২০ প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের সুযোগ লাভ একটি গর্বের বিষয়। নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ুসহ নানা ইস্যুতে বিশ্বে নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ এবার জি-২০-এ গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হয়ে অংশ নেবে।
তিনি আরও বলেন, জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে গত দেড় দশকে সরকারের অভাবনীয় সাফল্যের স্বীকৃতি। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা হবে এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি: আগামীকাল শনিবার জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী দুটি অধিবেশনে বক্তব্য দেবেন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার ও এক ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সম্মেলনে দুটি অধিবেশনে বক্তব্য দেবেন।
তিনি বক্তব্যে বর্তমান বিশ্ব সম্প্রদায়, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথে জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, ইউরোপে যুদ্ধের ফলে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার মতো যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তা মোকাবিলার কথা তুলে ধরবেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্জিত অভাবনীয় সাফল্যের অভিজ্ঞতা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে উপস্থাপন করবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আগামীকাল সরকারপ্রধান সম্মেলনের সাইডলাইনে একাধিক বিশ্ব নেতার সঙ্গে বৈঠকে করবেন। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী, কানাডার প্রধানমন্ত্রী, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এ ছাড়া আগামী রোববার প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে আসা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর তিনি জি-২০ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী যারা: নয়াদিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অ্যাম্বাসাডর-অ্যাট-লার্জ ও জি-২০-তে বাংলাদেশ শেরপা মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা।
বাংলা৭১নিউজ/এবি