বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানে দ্বৈত প্রশাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। একইসঙ্গে অধস্তন আদালতের সুষ্ঠু তদারকির স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে অবিলম্বে পৃথক সচিবালয় চালু, মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল সংশোধন তথা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সচিবালয় থেকে সংসদে স্থানান্তর, বিচারকদের নিয়মিত বদলি, বিচারক নিয়োগে দৃশ্যমান অনুসরণযোগ্য নিয়মকানুন প্রণয়ন, সর্বস্তরে প্রয়োজনের সংখ্যক বিচারক নিয়োগের উদ্যোগসহ আইনশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানোরও সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
বুধবার (২০ নভেম্বর) প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথককরণের ১৭ বছর’-শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় এ সুপালিশ করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্ত্বা হিসাবে থাকবে বলে ঘোষণা দিলেও, কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজ সোনার হরিণ হয়েই আছে। তাছাড়া দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই বিভাগ কোনো সময়ই সরকারের কাছ থেকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
দেশ, জাতি এবং বিচার বিভাগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কথাগুলো আইন কমিশনের একাদশ জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৩২তম বৈঠকে উপস্থাপনের নিমিত্তে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে বর্ণিত হয়েছে।
২০০৮ সালে থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মামলাজট বাংলাদেশের ইতিহাসে শিখরে পৌঁছেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ থেকেই মানুষ বেশি অবিচারের মুখোমুখি হয়েছে।প্রধান বিচারপতি তার প্রদত্ত অভিভাষণে বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস।
বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানে দ্বৈত প্রশাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ করে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ৭২-এর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে হবে। অবিলম্বে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের অবশিষ্ট নির্দেশনা, যা কার্যত অর্ধেকের বেশি এখনও অবাস্তবায়িত তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল সংশোধন তথা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সচিবালয় থেকে সংসদে স্থানান্তর করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থা উপমহাদেশে নেই। বিশ্বের কোথাও আছে বলে জানা যায় না। এই ব্যবস্থা একটি সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা চালু করেছে। এক দেশে দুই বিচার চলছে।
হাইকোর্টের রায়ের আলোকে এর বিলোপ দরকার। দেশ শাসনের জন্য যদি একে আপাতত চালু রাখতেই হয়, তাহলে এ বিষয়ে সংলাপ জরুরি। মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল সংশোধন তথা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সচিবালয় থেকে সংসদে স্থানান্তর করতে হবে।
অধস্তন আদালতের সুষ্ঠু তদারকির স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে অবিলম্বে পৃথক সচিবালয় চালু করাসহ অধস্তন আদালতের বিচারকরা যাতে একটি কর্মস্থলে তিন বছরের মেয়াদ পুরো করতে পারেন সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিচারক হিসেবে যোগদানের পর থেকে প্রতিটি স্তরে ফৌজদারি বিচার কার্যক্রমের পাশাপাশি দেওয়ানি বিচার কার্যক্রমের উপরও দক্ষতা অর্জন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও শহরাঞ্চলে বিশেষ করে প্রেষণে থাকা বিচারকদের যে যেখানেই কর্মরত থাকুক, তিন বছর পরে তাকে নিয়মিতভাবে বদলি করার সুপারিশ করেন তিনি।
‘সিনিয়র জেলা জজ’ স্কেল প্রাপ্ত হলেও বর্তমানে সচিবের পদমর্যাদা পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেতন দেওয়া চালু থাকলেও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাদেরকে উপসচিবের পদমর্যাদায় রাখা হয়েছে। এটি পুরো বিচার বিভাগের জন্য অবমাননাকর। কেননা একটি কর্মবিভাগের সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ‘উপসচিব’ পর্যায় বলে বিবেচিত বা গণ্য হলে তা সুস্পষ্টভাবে বৈষম্যমূলক, যা মেধাবীদের এ ধরনের কর্মবিভাগে যোগদান করাতে অনাগ্রহী করে তুলতে পারে।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অনুসরণযোগ্য নিয়মকানুন প্রণয়ন করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগে ইচ্ছাধীনতা পরিহার করে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে দক্ষ, সৎ, নিবেদিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগ দিতে হবে।
মামলাজট নিরসনের উদ্যোগসহ সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া বিচার বিভাগের জন্য যথাযথ বারদ্দ ও উন্নত অবকাঠামো নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ইকতেদার আহমেদ, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আকা ফিরোজ, গণমাধ্যম কমিশনের সদস্য জিমি আমীর, গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বরিশাল) ভিসি ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ