বাংলা৭১নিউজ, নরসিংদী: এক সময়ের আগাছা ফল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে লোভনীয় লটকন ফল হয়ে দেশে-বিদেশে বৃহৎ বাজার অর্জন করেছে। এই ফলটির নাম শুনলেই যেন জিভে জল চলে আসে। ইতিমধ্যে রুচিসহ মানবদেহের ব্যাপক খনিজ পদার্থ পূরণীয় উপকারী ফল হিসেবে বিস্তৃতি পেয়েছে। নরসিংদীর পাহাড়ি এলাকার বাগানগুলোতে এখন শুধু সোনালী লটকনের সমারোহ। কৃষি জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় চাষাবাদ হওয়া সুস্বাদু লটকন এখন দেশর সীমানা পেড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বাজারগুলোতে এর চাহিদাও রয়েছে প্রচুর।
এদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে লটকন ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে বলে কৃষকদের দাবী। কম খরচ আর অল্প পরিশ্রমে ফলন ও মূল্য দুটোই ভাল হওয়ায় লটকন এখন চাষীদের কাছে অন্য ফসলের তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান বলে পরিচিতি পেয়েছে। বিদেশ ফেরত ও বহু বেকার যুবক লটকনের চাষ করে তাদের মুখে ফুটিয়েছে অর্থনৈতিক সাফল্যের হাঁসি। প্রতি মৌসুমে এখানকার লটকন চাষীরা প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার মেট্রিকটন লটকন উৎপাদন করে থাকে। নরসিংদীর উৎপাদিত লটকন দেশে-বিদেশে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা বাজার মূল্য ধরে রেখেছে বলে কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের প্রত্যাশা।
সুস্বাদু আর পুষ্টি গুনে ভরপুর এখানকার লটকন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। এই মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভাল হয়েছে এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় খুশি কৃষকরা। স্বল্প ব্যয় আর অল্প পরিশ্রমে অভাবনীয় ফলন আসায় বাণিজ্যিকভাবে দিন দিন বাড়ছে লটকন চাষের জনপ্রিয়তা। এই বছর জেলায় ১৩৪২ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী লটকন চাষ হয়েছে শিবপুরে।
প্রতিবছর এখানকার কৃষকরা লটকন বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। প্রতি কেজি লটকন স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে। যা প্রবাসীদের দেশজ ফলের চাহিদাও মিটাচ্ছে।
লটকনের মৌসুমকে কেন্দ্র করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে জমে উঠেছে বৃহৎ লটকনের বাজার। জেলার সবচেয়ে বড় লটকনের বাজার বসে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী রায়পুরা উপজেলার মরজাল বাজারে। কামারটেক, চৈতন্য, জয়মঙ্গল, রায়পুরা ও বেলাবরের বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি হয়।
স্বল্প ব্যয় ও অল্প সময়ে ফলন আসায় নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাব উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের চাষীরা ক্রমেই ঝুঁকছে লটকন চাষে। লটকনের মৌসুমের শুরুতে প্রচণ্ড তাপদাহ, ক্ষরতা ও অতিবৃষ্টির কারণে ফলন আশা নুরুপ আসেনি, তাই এবার দেরিতে বাজারে বাজারজাত করতে হচ্ছে। তবে এ বছর বাজারে লটকনের দাম ভালো থাকায় খুশি এ অঞ্চলের চাষীরা। ফলন নিয়ে চিন্তিত নয় তারা।
বেলাব উপজেলার উজিলাবো গ্রামের কৃষক আতাউল্লা ভূঁইয়া জানান, দিনে দিনে আমাদের এলাকায় লটকনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারীরা এখন লটকন কিনে বিদেশও পাঠাচ্ছে। তাই আমরা এখন অন্য ফসলের তুলনায় লটকন চাষ করে ভালো দাম পাচ্ছি। তাই কৃষকরাও লাভবান হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বাজারে প্রতিদিন কাক ডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ টাকা এবং বাগান থেকেই প্রায় ৩০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই ফলে ওষধি গুনাগুণ রয়েছে অনেক। এর মধ্যে ডায়াবেটিক ও প্রেসার নিয়ন্ত্রণসহ রুচি বর্ধক ফল হিসেবে প্রচার পাওয়ায় সর্বস্তরে এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর লটকন আবাদ করে স্বাবলম্বী নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার অনেক কৃষক। ইতিমধ্যে এসব এলাকার মানুষের কাছে লটকন এখন অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানান, পাহাড়ি অঞ্চলের লাল রংয়ের মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকায় এ এলাকার মাটি লটকন চাষের খুবই উপযোগী। এক সময় জংলি ফল হিসেবে পরিচিত ছিল লটকন। সময়ের বিবর্তনে লটকন এখন পুষ্টি গুনে ভরপুর সুস্বাদু একটি ফল। আধুনিক বিজ্ঞান মতে লটকনে ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি রয়েছে। পাশাপাশি প্রচুর ক্যালোরি ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ থাকায় ভোক্তাদের কাছে দিন দিন বাড়ছে এ ফলের কদর।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. লতাফত হোসেন জানান, লটকন দৃষ্টিনন্দন ও ওষধি গুনাগুণ সমৃদ্ধ একটি সুস্বাদু ফল। নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাবো উপজেলার চাষী আর বেকার যুবকদের কাছে এটি একটি অর্থকড়ি ফল। তেমন কোনো পরিশ্রম ছাড়াই উৎপাদিত হয় এই ফল। অত্যন্ত মিষ্টি আর পুষ্টিসমৃদ্ধ এখানকার লটকন দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। তাই কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। আর আমরা কৃষি অধিদপ্তর গবেষণা করছি কিভাবে এর ফলন আরও বৃদ্ধি করা যায়।
তিনি আরো জানান, আমরা কৃষি বিভাগ চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে সারা বছরই আমাদের বাজারে দেশিয় ফল থাকে। বিদেশী ফল যেন আমরা পরিহার করতে পারি এবং দেশের টাকা দেশে রাখতে পারি। এজন্য লটকন চাষীরা যাতে আরোও লাভবান হন। তাই তাদেরকে আগাম ও নামীজাতের চারা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও লটকন ফল যাতে দুই তিন মাস থাকে সে দিকে নজর দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। যদি বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর ফলন বৃদ্ধির কোনো উপায় পাওয়া যায় তাহলে তা এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির একটি মজবুত ভীত গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে।
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস