বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম রাতারাতি ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে আগে কখনও জ্বালানি তেলের দাম একসঙ্গে এতটা বাড়ানো হয়নি। এই মূল্য বৃদ্ধি জনজীবনে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ।
লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। অকটেনের দাম বেড়েছে ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ পেট্রল ও অকটেনের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।
শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে নতুন এই মূল্য কার্যকর করা হয়েছে।
পাচার ঠেকানোর যুক্তি
আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দামের পাশাপাশি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে ভারতে তেল পাচারের ঝুঁকি কমাতেও বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম প্রতিবেশী ঐ দেশের সম-পর্যায়ে আনা প্রয়োজন ছিল।
বলা হয়েছে যে ভারত ২২মে ২০২২ তারিখ থেকে কলকাতায় ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৯২.৭৬ রুপি এবং পেট্রোল লিটার প্রতি ১০৬.০৩ রুপি নির্ধারণ করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় যথাক্রমে ১১৪.০৯ টাকা এবং ১৩০.৪২ টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে উদ্ধৃত করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে “অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা এডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে।” তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব-এর সহ সভাপতি শামসুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম রাতারাতি এতটা বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে “ভয়াবহ দুর্দশা” নেমে আসবে। তিনি বলেন, কৃষি, পরিবহণ সহ সব খাতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
জেলায় জেলায় বিক্ষোভ
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খবরে রাত ১২টা বাজার আগেই জেলায় জেলায় পেট্রলপাম্প বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেছেন মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা।
সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
সিলেটে পাম্পগুলো রাত ১২টা বাজার আগেই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন মোটরসাইকেলচালকেরা। সিলেটের চারটি জ্বালানি তেল বিক্রি করা পাম্প ঘুরে দেখা গেছে, আলো নিভিয়ে কর্তৃপক্ষ চলে গেছে। পাম্পগুলোতে কয়েক শ মোটরসাইকেলের লাইন। চারটি পাম্পের একটিতে রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা।
নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার নর্থ ইস্ট অয়েল ফিলিং স্টেশন, জিন্দাবাজার এলাকার জালালাবাদ ট্রেডার্স ও সোবাহানীঘাট এলাকার একটি পাম্পের আলো নেভানো এবং পাম্প বন্ধ অবস্থায় দেখা গেছে।
মোটরসাইকেল আরোহীদের অভিযোগ, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেল বিক্রি করা হয়েছে। হঠাৎই তেলের দাম বাড়ানোর খবরে পাম্পমালিক ও কর্মচারীরা তেল বিক্রি বন্ধ করে দেন। সেই সঙ্গে পাম্পগুলোর আলো নিভিয়ে বন্ধ করে চলে যান। এতে পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেল নিতে আসা মোটরসাইকেল ও যানবাহনের চালক এবং আরোহীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
রাত ১১টার দিকে সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার বেঙ্গল গ্যাসোলিন অ্যান্ড সার্ভিস ফিলিং স্টেশনের সামনে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। এ সময় পাম্প কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁদের চালকদের বাগ্বিতণ্ডা করতে দেখা যায়। পাম্পের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাম্পমালিক বিক্রি বন্ধ করে রাখতে বলেছেন। এতে আমাদের কিছু করার নেই। একপর্যায়ে মোটরসাইকেল ও যানবাহনের চালকেরা পাম্পের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।’
রাত পৌনে ১১টার দিকে সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার নর্থ ইস্ট অয়েল পাম্পেও মোটরসাইকেলের চালকদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। তেল না পেয়ে একপর্যায়ে তাঁরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের প্রায় সব ফিলিং স্টেশন শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন দুই শতাধিক গ্রাহক।
বেড়াইদেরচালা সোবহানীঘাট এলাকার বেঙ্গল গ্যাসোলিন অ্যান্ড সার্ভিসিং স্টেশনে পেট্রল নিতে আসা নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা ফাহাদ মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এ খবর শোনার আগে পাম্পে এসেছিলাম। কিন্তু তারা তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছি।’
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) বি এম আশরাফ উল্যাহ বলেন, পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেল না পেয়ে অনেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে পুলিশ মাঠে রয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটের পলিটেকনিক এলাকার সেনা ফিলিং স্টেশনে রাত সাড়ে ১১টার দিকে দেখা যায়, কমপক্ষে ২০০ মোটরসাইকেলচালক তেল কেনার অপেক্ষায়। এ ছাড়া ৫০টির মতো ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস অপেক্ষায় রয়েছে।
আরিফুর রহমান নামের এক মোটরসাইকেলচালক বলেন, তেলের দাম বাড়ানো খবর শুনে তিনি তেল কিনতে আসেন। প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর তেল পান। তাঁর কাছে ২০০ টাকার তেল বিক্রি করেছে। এর বেশি বিক্রি করেনি।
রাত ১২টার দিকে গণি বেকারি এলাকার আরেকটি ফিলিং স্টেশন কিউসি ট্রেডিংয়ে গিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সেখানে তেল নিতে এসে কমপক্ষে ১০ জনকে ফেরত যেতে দেখা যায়।
পেট্রল ও অকটেন বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় সাতক্ষীরা শহরের এ বি খান পেট্রলপাম্পের সামনে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। রাত সোয়া ১১টার দিকে তাঁরা রাস্তা অবরোধ করলে ১৫ মিনিট পর পুলিশ এসে তাঁদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।
রাজশাহীতে পেট্রলপাম্পে তেল দেওয়া বন্ধ করায় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেছেন মোটরসাইকেলচালকেরা।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের প্রায় সব ফিলিং স্টেশন শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন দুই শতাধিক গ্রাহক।
দেশে জ্বালানি তেলের দাম হুট করে এত বেশি বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম। তিনি বলেছেন, দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে।
সরকার এর আগে গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ টাকা লিটার। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একই ভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ।
ম. তামিম বলেছেন, ভারতের সঙ্গে দামের পার্থক্য সব সময় ছিল। এখন পাচারের প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেছেন, ডিজেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যারেলে ১৭০ ডলার থেকে নেমে ১৩০ ডলারে নেমেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ১০০ ডলারের মধ্যে এসেছে। এই দর এ বছর ৭০ থেকে ৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এমন সময় হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে বলে মনে হয় না।
যাত্রীদের উপর চাপ বাড়বে
জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে যাত্রীদের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ। তিনি বলেছেন, এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির আছে কি না, তা মনে পড়ছে না।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করেছেন শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ ঘোষ। দ্রব্যমূল্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বাংলা৭১নিউজ/এসিইচ