১৪ নভেম্বর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। ওই সভায় দলের অধিকাংশ সদস্য মত দেন ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে। উপস্থিত নেতাদের সামনে সেদিন জিএম কাদের বলেন, নির্বাচনে যাওয়ার এখনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। সুষ্ঠু পরিবেশ না হওয়ার আগে নির্বাচনে গেলে আমাদের ওপর স্যাংশনস আসার শঙ্কাও রয়েছে।
ওই সভায় জাপার চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রথমত এ অবস্থায় নির্বাচন করলে জাতীয় বেইমান বা দালাল হিসেবে বলা হবে।
এ বক্তব্য দেওয়ার কিছুক্ষণ পর সেদিন রাতেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গভবনে যান জাপা চেয়ারম্যান। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী আলাপ শেষে রাত সোয়া ৯টায় বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যান। সেসময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
তার ৫ দিন পর, ২০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর মাধ্যমে নির্বাচনী ট্রেনে উঠে পড়ে জাতীয় পার্টি। ২০ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম বিক্রি আর ২৪ থেকে ২৬ নভেম্বর হয় ৮ বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার। এরপর ২৭ নভেম্বর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দলটি।
১৪ নভেম্বররের পর কেটে গেছে প্রায় ১ মাস। এরমধ্যে সাক্ষাৎ মেলেনি জিএম কাদেরের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দামামা যখন বাজছে তখন যেন ‘শীতঘুমে’ জিএম কাদের। মনোনয়ন ফরম বিক্রির উদ্বোধন বা প্রার্থী ঘোষণার দিন উপস্থিত ছিলেন না জাপা চেয়ারম্যান।
মাঝে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হলেও মিডিয়া কর্মীদের এড়িয়ে গেছেন। রওশন এরশাদ, নির্বাচন, আসন বণ্টনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। নানান আলোচনা, সমালোচনার পরও আড়ালের কাদের আড়ালেই থাকছেন।
নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। ভোট সুষ্ঠু করতে রয়েছে দেশি-বিদেশি চাপ। এমন সময়ে জিএম কাদেরের নিশ্চুপ থাকা ও গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলা জন্ম দিয়েছে সংশয় ও প্রশ্নের।
এবার ঢাকা-১৭ ও রংপুর-৩ আসনে ভোট করবেন জিএম কাদের। দুই আসনের পৃথক রিটার্ননিং অফিসারের অফিস থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন তার প্রতিনিধি। নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থীরা যখন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, তখন নীরবতা পালন করছেন জিএম কাদের। জিএম কাদেরের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন তার প্রেস উপদেষ্টারাও।
দলটির সূত্র জানায়, গণমাধ্যম এড়িয়ে চললেও জাপার নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন চেয়ারম্যান। দিচ্ছেন নির্বাচনী দিকনির্দেশনা। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, যার পুরোটাই তত্ত্বাবধান করেছেন জিএম কাদের।
জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্তনুযায়ী রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন জিএম কাদের।
এদিকে দুই দফা বৈঠকের পরও আসন ছাড় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি জাপা। দলটি আওয়ামী লীগের কাছে ৩৫-৪০টির মতো আসন চেয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ আরও কিছুদিন সময় চেয়েছে জাপার কাছে। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্ন এড়াতে চাইছেন জিএম কাদের। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নানান সমালোচনা করে নিজেই কেন নির্বাচনে গেলেন, সে প্রশ্নের মুখেও পড়তে চান না তিনি।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার এক নেতা বলেন, ১৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় সবাই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করি। তবে আমরা আগের অবস্থানের ঠিক বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ফেলেছি। এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন যায়গায় সমালোচনা হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে।
সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে বা পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে ভোট থেকে সরে আসতে পারে জাপা। এসব বিষয়ে আগাম মন্তব্য এড়াতেও গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন জিএম কাদের। যদিও জাপা মহাসচিবের দাবি, নির্বাচন-রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। দলের প্রয়োজনে যে কোনো সময়, যে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে।
মুজিবুল হক চুন্নুর দাবি, প্রয়োজন ছাড়া পার্টির চেয়ারম্যানের কথা বলার দরকার নেই। এরমধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
তিনি বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দু-তিন জনই কথা বলেন। এ বিষয়ে উনাদের দলের সভাপতি (প্রধানমন্ত্রী) কথা বলেন বলে আমার জানা নেই। ঠিক জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল, জাতীয় পার্টির মুখপাত্র হিসেবে মহাসচিব এবং চেয়ারম্যান কথা বলবেন।
চেয়ারম্যান নাম্বার ওয়ান ব্যক্তি, খুব প্রয়োজন ছাড়া চেয়ারম্যানের কথা বলার দরকার নেই। আরেকটা হলো, আমি যা বলছি, সেটা দলের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের কনসার্ন নিয়েই বলছি। এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নাই।
যদিও আগস্টে ভারত সফরের পর থেকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি খুব কমই হয়েছেন জিএম কাদের।
ভারত থেকে ফিরে জিএম কাদেরের নীরবতা প্রসঙ্গে চুন্নু গত ৭ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত থেকে আসার পর প্রায় সাড়ে তিন মাস হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান আগে যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, পরেও একই বক্তব্য দিয়েছেন। উনার বক্তব্যের ঝাঁজ কোনো অংশে কমেনি। এগুলো অনুমান ভিত্তিক।
আমি আর চেয়ারম্যান যখন ব্যাংককে তখন আপনারা এ প্রশ্ন করেননি। চেয়ারম্যান যখন ভারতে গেলো, তখন এ প্রশ্ন আনলেন। এটা আমাদের একটা মানসিকতার মধ্যে ঢুকে গেছে। আমেরিকায় গেলে এ প্রশ্নটা করতেন না।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ