বাংলা৭১নিউজ, নুরুল আলম বাকু, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গা থেকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে জেলার হাজারো প্রাকৃতিক নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম তাল গাছ। যে হারে তালগাছ কাটা হচ্ছে সেই তুলনায় রোপন করা হচ্ছে না। এখনই ব্যাবস্থা না নিলে আগামী এক দশকে চুয়াডাঙ্গা থেকে হারিয়ে যাবে তালগাছ এমনই মন্তব্য সচেতন মহলের।
আমাদের রূপসী বাংলার অন্যতম প্রতিকৃতি এই তাল গাছ। বিভিন্ন সময়ে দেশের খ্যতিমান কবি সাহিত্যিকরা এ গাছকে নিয়ে “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে ঊঁকি মারে আকাশে”, “ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ ঐ খানেতে বাস করে কানা বগির ছা”, এর মতো কত যে কবিতা রচনা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এক সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার গ্রামীণ জনপদে বিপুল সংখ্যক তাল গাছ ছিল যা চোখে পড়ার মতো। দুর থেকে উঁচু তালগাছ দেখিয়ে বাড়ির ঠিকানা বলা হতো। জেলার গ্রামীণ জনপদের একটি গ্রামের নাম তালতলা। জনশ্রুতি আছে, অতীতে এ গ্রামে অনেক তালগাছ ছিল তাই কালক্রমে এ গ্রামটি তালতলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে যা আজও বিদ্যমান। তবে বর্তমানে তালতলা গ্রামেও আগের মতো আর তালগাছ দেখা যায় না। বর্তমানে এক শ্রেনির অর্থলোভী মানুষ প্রকৃতির এ অন্যতম নিদর্শনটি মুছে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছে। নির্বিচারে এ গাছ কাটার ফলে গ্রামীণ জনপদ থেকে গ্রাম বাংলার প্রতিকৃতি ও ঐতিহ্য বিলীন হতে চলেছে। বিগত শতাব্দীতে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু জমিদারদের বসবাস ছিল। তারা ওই সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানা প্রজাতির ফলদ বাগান করেছিলেন। সেইসাথে সৌন্দর্য রক্ষায় রোপন করেছিলেন বাগানের চারপাশে ও বিভিন্ন রাস্তার ধারে অসংখ্য তালগাছ। তারই কিঞ্চিৎ নিদর্শন এখনও জেলার ডিসি ইকো পার্কে যাওয়ার পথে নাটুদাহ-শিবনগর রাস্তার দুই ধারে নয়নাভিরাম তাল গাছের সারি (রাস্তাটি তালসারি নামে পরিচিত) চোখে পড়ে। হঠাৎ করে চোখে পড়া এ দৃশ্য সবারই মন কাড়ে।
সম্প্রতি একটি মহল এ গাছগুলোও কেটে ফেলার পায়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ক’য়েক দশকে এলাকার বড় বড় তালগাছগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বাকি গাছগুলোও কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কাঠ ব্যাবসায়ীরা নামমাত্র মূল্যে এসব গাছ কিনে বিভিন্ন সাইজে চেরাই করে বিক্রি করছে। এছাড়া অনেক ব্যাবসায়ী ট্রাক লোড করে লম্বা তালগাছ ও এর চেরাইকৃত তালকাঠ ঢাকা, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান করে। স্থানীয়রা জানান, পাইকারি হারে তালগাছ নিধনযজ্ঞ চলতে থাকায় তালশাঁস, তালের রস, গুড়, পাটালি ও তালের পিঠা খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার মানুষ। আগেকার মতো এখন হাটবাজারে আর পাকা তাল খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে তালপিঠার পুরোনো ঐতিহ্য। আর মানুষও ভুলতে বসেছে তালগাছ থেকে পাওয়া এসব খাবারের স্বাদ।
পরিবেশ রক্ষায়ও তালগাছের জুড়ি নেই। তালগাছ অপেক্ষাকৃত উচু ও নিরাপদ হওয়ায় এসব গাছে বাবুই, শকুন, চিল, শালিক, পেঁচা, বক, ঘুঘুসহ নানা জাতের পাখি বাসা বেঁধে বসবাস করতো। তালগাছ নিধনের ফলে আবাসস্থল সংকটে বর্তমানে এসব পাখিও এলাকা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির উপর। অভিজ্ঞ মহলেরর অভিমত, যে হারে তালগাছ কাটা হচ্ছে সেই তুলনায় রোপন করা হচ্ছে না। সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষনায় প্রমানিত হয়েছে বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছ রোপনের কোন বিকল্প নেই। নির্বিচারে তালগাছ নিধন করার ফলে ইতোমধ্যে এলাকার পরিবেশের উপর এর কূ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিগত পাঁচ বছরে জেলার বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে নানা বয়সী অন্ততঃ অর্ধ শত মানুষ। সেইসাথে আহত হয়েছে অনেকে।
জেলা কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষন কর্মকর্তা জানান, বজ্রপাতের ফলে মানুষজন ও গবাদি পশুর প্রাণহানি রোধ ও সেইসাথে বাড়িঘর রক্ষা করতে সরকার ইতোমধ্যে সারা দেশে ১০ লক্ষ তালগাছ রোপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আশা করা যায় আগামী এক দশক পর থেকেই বজ্রপাতের কারনে প্রাণহানিসহ ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান কমে আসবে।
সচেতনমহল মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী এ তালগাছের নানাবিধ উপকারিতা ও গুরুত্ব তুলে ধরে এ গাছ রক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তোলা দরকার। সেইসাথে তালগাছ রক্ষায় প্রকল্প প্রনয়ন ও তার বাস্তবায়ন জরুরি।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস