জীবনের প্রয়োজনে সমাজের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। চালচলনে, কথাবার্তায় ও ওঠাবসায় আমরা নানা রকম ভুল করে থাকি। মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তবে বিচক্ষণ মানুষ অন্যকে দেখে নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করে নেয়। আবার কখনো অন্যকে সংশোধন করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) কিভাবে অন্যদের ভুলগুলো সংশোধন করে দিয়েছেন তা জানা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো—
অপরাধীর প্রতি নম্রতা প্রদর্শন : মুআবিয়া ইবনে হাকাম আস-সুলামি (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সাথে নামাজে ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি হাঁচি দেয়। আমি তার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলি। তখন উপস্থিত লোকজন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলে আমি বললাম, ধুর! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? তখন মানুষজন (বিস্মিত হয়ে) তাদের উরুতে চাপড়াতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি যে, তারা আমাকে চুপ করতে বলছে। আমি চুপ হয়ে যাই।
রাসুল (সা.) নামাজ শেষ করে আমাকে ডাকলেন। তিনি (নামাজে আমার অবাঞ্ছিত কথাবার্তার জন্য) আমাকে তিরস্কারও করলেন না এবং কটু কথাও বললেন না। আমি তাঁর আগে ও পরে তাঁর চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। তিনি শুধু বললেন, ‘আমাদের জন্য নামাজে কথা বলা সমীচীন নয়। নামাজ হলো তাসবিহ, তাকবির এবং কুরআন তেলাওয়াতের সমষ্টি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৩৭)
নম্র ভাষায় ভুল সংশোধন : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে মসজিদে বসে ছিলাম। এ সময় হঠাৎ এক বেদুইন এসে মসজিদের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে লাগল, তা দেখে সাহাবারা থামো থামো বলে তাকে প্রস্রাব করতে বাধা দিলেন। তখন রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা তাকে বাধা দিয়ো না, বরং তাকে ছেড়ে দাও। লোকেরা তাকে ছেড়ে দিল, সে প্রস্রাব সেরে নিল। তখন রাসুল (সা.) তাকে কাছে ডেকে বলেন, এটা হলো মসজিদ। এখানে প্রস্রাব করা কিংবা ময়লা-আবর্জনা ফেলা যায় না। বরং এটা হলো আল্লাহর জিকির, নামাজ আদায় এবং কোরআন তিলাওয়াত করার স্থান। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮৫)
আকার-ইঙ্গিতে ভুল শুধরিয়ে দেওয়া : আবু হুমায়দ আস-সাইদি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুল (সা.) আজদ গোত্রের ইবনুল লুতবিয়্যা নামের এক লোককে সদকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বললেন, সে তার বাবার ঘরে কিংবা তার মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না। তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি দেয় না? (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৭৯)
প্রয়োজনে রাগ করা : আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একটি বালিশ বা গদি কিনে এনেছিলাম, যাতে ছবি ছিল। যখন রাসুল (সা.) সেই ছবিটি দেখলেন, তিনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গেলেন; ভেতরে প্রবেশ করলেন না। আমি বুঝতে পারলাম যে রাসুল (সা.) এটা অপছন্দ করেছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আল্লাহর কাছে তাওবা করছি এবং তাঁর রাসুলের কাছে ফিরে আসছি।
আমি কী অন্যায় করেছি? তখন রাসুল (সা.) বললেন, এই বালিশ কিসের জন্য? আমি বললাম, এটা আপনার জন্য কিনে এনেছি, যাতে আপনি বসতে পারেন এবং হেলান দিতে পারেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, এই ছবি নির্মাতাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি প্রদান করা হবে এবং বলা হবে, তুমি যা সৃষ্টি করেছ তার প্রাণ দাও এবং তিনি আরো বলেন, যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে, সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৮১)
অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলা : আবু উমামা আল-বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুল (সা.)-এর কাছে কাছে এক যুবক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। এ কথা শুনে লোকজন চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু রাসুল (সা.) যুবকটিকে কাছে নিয়ে বললেন, কেউ তোমার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হোক এটা কি তুমি চাও? যুবকটি বলল, আপনার জন্য আমি কোরবান হই।
কোনো মানুষ চায় না তার মায়ের সঙ্গে কেউ ব্যভিচার করুক। রাসুল (সা.) আবার বললেন, কেউ তোমার মেয়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হোক এটা কি তুমি চাও? যুবকটি বলল, আপনার জন্য আমি কোরবান হই। কোনো মানুষ চায় না তার মেয়ের সঙ্গে কেউ ব্যভিচার করুক। এভাবে রাসুল (সা.) তার বোন, ফুফু ও খালার কথা উল্লেখ করেন আর যুবকটি তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। এরপর রাসুল (সা.) যুবকটির গায়ে হাত রেখে বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন। তার অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করে দিন। তার লজ্জাস্থানকে হেফাজত করুন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৪১১)
ক্ষমা করা : অনেক সময় অপরাধের শাস্তি প্রয়োগের চেয়ে ক্ষমা করে দেওয়া অনেক বেশি কার্যকর। হাতেব ইবনে আবি বালতাআ (রা.) মক্কার কুরাইশদের মক্কা বিজয়ের জন্য রাসুল (সা.)-এর প্রস্তুতির খবরটি পত্র মারফতে জানিয়ে দেন। তবে তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে ধরা পড়ে যান। তখন রাসুল (সা.) তাকে ক্ষমা করে দেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ