বাংলা৭১নিউজ, ঢাকা: মাদক জাতি গঠণের অন্যতম অন্তরায়। একটি জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে মাদককে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেও মাদকের ভয়াবহতা বেড়েছে। গোটা সমাজ এ নিয়ে আতঙ্কিত। বাংলাদেশকে এখন সীমান্তবর্তি দেশগুলো মাদক ব্যবসা এবং মাদক পাচারের পথ হিসাবে ব্যবহার করছে।
মাদকের এমন ভয়াবহতা রুখতে সরকার মাদক ব্যবহারকারি এবং এই জঘণ্য ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত অন্তত ২শতাধিক ব্যক্তি ‘বন্দুক যুদ্ধ’-এ মারা গেছে। এরপরও থেমে নেই রাজধানীর পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে জেলা শহর এবং গ্রামের দূর্গম এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের ভয়াল থাবা।দেশের সর্বত্রই চলছে মাদক ব্যবসার জমজমমাট হাট।
এই মাদক ব্যবসার সাথে কারা জড়িত? কিভাবে সীমান্ত পারি দিয়ে দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে এসব নেশার সামগ্রী। অভিযোগ রয়েছে সমাজের এক শ্রেনীর রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর কতিপয় সদস্য এবং সমাজের উচুঁতালার কিছু ব্যক্তি এই কালো ব্যবসার সাথে জড়িত। পুলিশ, র্্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাদের নামও রয়েছে। এসব ঘৃণিত ব্যক্তির গতিবিধি গোায়েন্দা সংস্থা পর্যক্ষেণও করছে। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এসব রাঘব বোয়ালদের কেউ ধরা পরেনি। কিম্বা ‘বন্দুক যুদ্ধে’ প্রান হারায়নি।
বাংলা৭১নিউজ এর পক্ষ থেকে মাদক সেবনের ভয়াবহতা নিয়ে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করেছেন শহীদুল ইসলাম সোহাগ। প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:
‘‘বাবা ও মার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল চোর-পুলিশের মতো।সব সময় কেমন যেন সন্দেহ করতো।কিন্তু বিশ্বাস করতো না আমি অন্ধকার জগতে পা দিয়েছি।’’ কথাগুলো বলছিলেন, এক সময় মাদকের ওপর নির্ভরশীল ১৭ বছরের (ছদ্ম নাম) শাহানা আক্তার।
মিনা আপু (ছদ্ম নাম) আমার খালাতো বোন।একদিন তার ঘরে ঢুকেই দেখি চারিদেক ধোঁয়াশাতে অন্ধকার।জিজ্ঞাসা করতেই বলে, খাবি নাকী ‘ইয়াবা’। নিজেকে অন্যরকম মনে হবে।আর সেই ‘ইয়াবা’ দিয়েই আমার নেশার জগতে প্রবেশ।
রাজধানীর আহ্ছানিয়া মিশনের মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূনর্বাসন কেন্দ্রে থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এভাবেই শাহানা আক্তার তার অবস্থার কথা তুলে ধরলেন। একপ্রকার জোড় করেই আমাকে এই মাদকের নেশাতে প্রবেশ করতে হলো।
মিনা আপু প্রথমেই আমাকে ‘ইয়াবা’ খাওয়া শেখায়।পরে গাজা এবং সিগারেট খাওয়া ধরি।আর এভাবেই চলতে থাকে আমিসহ আমার ৫-৬ বন্ধুর নিয়মিত নেশা।আর এ জন্য আমি মিনা আপুকেই দায়ী করি।২০১৩ সাল থেকেই আমি এই নেশাতে জড়িয়ে পড়ি।যার কারণে আজও আমি মাধ্যমিক পাশ করতে পারিনি।
এদিকে মাদক সেবনের প্রবণতা বা মাদকাসক্তির দিকে কেন নারীরা ঝুঁকে পড়ছে সে বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, ‘‘মাদকের সহজলভ্যতা, ফ্যাশান, সমাজে নিজেকে উচ্চ স্থানে উঠিয়ে নেওয়া এবং ছেলেরা পারলে আমরা কেন পারবো না।সহজ কথায়, এমন মানসিকতায় আজকের নারীদেরকে এই পথে ধাবিত করছে।’’
আমাদের অভিভাবকদের সঠিক দৃষ্টি ও নজরের আওতায় তাদের সন্তানদের রাখতে হবে।তাহলে কিছু ঘটার আগেই তা সামাল দেওয়া যাবে বলেও জানান মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।
নারীদের মাদকাসক্তি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো.সাহানুর হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের মেয়েদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে।যার কারণে ড্রাগ এডিকশনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তারা।’’
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় দেখা গেছে, একজন সমবয়সী ছেলে মাদক নিলে আর অন্যদিকে একজন সমবয়সী মেয়ে মাদক নিলে বেশি ড্রাগ এডিকশন হয় মেয়েরা।সে ক্ষেত্রে ছেলেরা তুলনামূলক কম হয় বলেও জানান তিনি। তিনি আরো জানান, ‘‘ওয়েস্টার্ন কালচারের কারণে আমাদের বুদ্ধিমান নারীরা ঐ দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি’র ঠিক মতো প্রচার নেই।তাই বুদ্ধিমান মেয়েরা ধীরে ধীরে ঐ পশ্চিমা সংস্কৃতি’র দিকে আসক্ত হয়ে মাদকের দিকে প্রভাবিত হচ্ছে।’’
নারীদের মাদক সেবনের পেছনে কিছু কারণ তুলে ধরে এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘‘মেয়েরা কাজ করতে বাড়ির বাইরে যায়।আর সেখানে তারা ‘প্লেজার’ বা নেশা পাচ্ছে।কোন ছেলে বন্ধু মাদক গ্রহণ করলে, তার মাধ্যমে ঐ মেয়ে বন্ধুকে মাদক পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।’’
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো.সাহানুর হোসেন আরো বলেন, ‘‘আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা নারী রোগীদেরকে অবজারভেশন করে দেখা যায় যে, নারীদেরকে সেক্স ওয়ার্কার ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ফেলেছে।আর এ থেকে তারা ক্রমশই মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।অথচ একটি শ্রেণী কিন্তু আর্থিক দিক থেকে লাভবান হচ্ছে।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক ডা.হেলাল উদ্দিন আহমেদ নারীদের মাদক সেবনের প্রবণতা নিয়ে বলেন, ‘‘সহজ লভ্যতা, হোম ডেলিভারি, সমবয়সীদের চাপ, কৌতুহল, হতাশা, পরীক্ষায় ফেল, প্রেমে ব্যর্থ ও মজা করার জন্যই মাদক নেয়।”
তিনি বলেন, “অনেক সময় স্বামী ও স্ত্রী একই সঙ্গে মাদক সেবন করে।যা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে।এমন কি সরাসরী প্রভাব ফেলে।” তিনি আরো জানান, “যারা দীর্ঘ দিন ধরে মাদক নেয়, তারা মাদক জনিত রোগে ভুগে।যা আমরা মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় বলি ‘সাইকোটিক’ রোগ।”
২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ০.৬ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্করা মাদকাসক্ত ছিল। আবার ২০০৯ সালে ঢাকা বিভাগের ১৫টি জেলার ৩৮টি উপজেলায় ০.৮ মাত্রায় শিশুদের মধ্যে মাদকাসক্তির লক্ষণ দেখা যায়।যা চার হাজার শিশুর উপর কমিউনিটি সার্ভেতে এই তথ্য উঠে আসে।তাই পূর্বের তুলনায় এ চিত্র বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূর্ণবাসন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার উম্মে জান্নাত নারী মাদকাসক্তিদের চিকিৎসার বিষয়ে বলেন, “আমাদের এই প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা এ পর্যন্ত ২৫০ জন মাদকাসক্ত নারীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছি। এখন তারা পরিবারের সাথে সুস্থ্য ভাবে জীবন-যাপন করছে।”
নারীদের মাদক সেবনের বিষয়ে আমাদের এখানে নানান রকমের কেস আসে। আর আমরা সেগুলোকে কেস অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবে সেবা দিয়ে থাকি বলেও জানান তিনি।
বাংলা৭১নিউজ/এসআইএস