পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। এরমধ্যে নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন হয় না। অন্য যে ২২টি কোম্পানির শেয়ার নিয়মিত লেনদেন হয়, তার মধ্যে ১০টিতে আছে বিদেশি বিনিয়োগ। অন্য ১২ কোম্পানির শেয়ারে বিদেশিদের কোনো বিনিয়োগ নেই।
তবে যে ১০টি কোম্পানির শেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে, তার পরিমাণও বেশ কম। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গেলো আগস্টে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কোম্পানিগুলোর সবশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের বিনিয়োগচিত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বে-লিজিং, ডিবিএইচ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, আইডিএলসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স ও উত্তরা ফাইন্যান্সের শেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে।
এরমধ্যে আগস্টে বে-লিজিং, ডিবিএইচ, আইডিএলসি, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ও মাইডাস ফাইন্যান্সের বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। বর্তমান বাজারদরে বিদেশিদের বিক্রি করে দেওয়া শেয়ারের মূল্য ১০৪ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা। বড় অঙ্কের এ শেয়ার বিক্রি করার পর বর্তমানে বিদেশিদের কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৬৬০ কোটি আট লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার আছে।
বিদেশি বিনিয়োগ না থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিপিএইচ ফাইন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), ইসলামিক ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও বিডি ফাইন্যান্স। এসব প্রতিষ্ঠানে দেশি বিনিয়োগের অবস্থাও খুব ভালো নয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিদেশি বিনিয়োগ না মেলার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একাধিক কোম্পানির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পিপলস লিজিংয়ে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে আর্থিকখাতের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না। এমনকি দেশীয় বিনিয়োগকারীদেরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা কমেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাজারমূল্য অনুযায়ী বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ডিবিএইচ-এর শেয়ারে। কোম্পানিটির ২০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৫৬ লাখ ১২ হাজার শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩০৪ কোটি ১২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। আগস্টে কোম্পানির ৩৯ লাখ ১৭ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দেন বিদেশিরা, যার বাজারমূল্য ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
গেল আগস্টে বিদেশিরা সবচেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন আইপিডিসির। আগস্টে কোম্পানির ৭৩ লাখ ১০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩৪ কোটি ৪৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা। বিদেশিরা এ বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর এখন কোম্পানিটির ১১ লাখ ১৩ হাজার শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে, যার বাজারমূল্য পাঁচ কোটি ২৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
আইডিএলসি থেকেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। গত আগস্টে কোম্পানিটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা, যার বাজারমূল্য ৩৪ কোটি ১০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এ বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর বর্তমানে কোম্পানিটির তিন কোটি ৯১ লাখ ৫৪ হাজার শেয়ার বিদেশিদের কাছে আছে, যার বাজারমূল্য ২৭৮ কোটি ৭৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
বিদেশিদের বিনিয়োগ তুলে নেওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাইডাস ফাইন্যান্সের সাত লাখ ৯৭ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা, যার বর্তমান বাজারমূল্য এক কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর বর্তমানে কোম্পানিটির দশমিক ৪২ শতাংশ বা পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে, যার বাজারমূল্য এক কোটি ৩৭ লাখ দুই হাজার টাকা।
এছাড়া লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ৫৪ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা, যার বাজারমূল্য ২৩ লাখ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির ৪২ লাখ ৫৬ হাজারটি অর্থাৎ ১৮ কোটি ১৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকার শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে।
বে-লিজিংয়ের ২৮ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশিরা, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এ বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর বর্তমানে কোম্পানিটির এক লাখ ৯৯ হাজার শেয়ার বিদেশিদের কাছে রয়েছে। এ শেয়ারের বাজারমূল্য ৬১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
অন্যদিকে বিনিয়োগ অপরিবর্তিত থাকা চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্সে ৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, প্রাইম ফাইন্যান্সে চার লাখ ৩৬ হাজার টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৩৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা এবং ফারইস্ট ফাইন্যান্সে ছয় লাখ ৯৭ হাজার টাকার শেয়ার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিদেশিদের কম বিনিয়োগ করার কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। এ কারণে এ খাতের শেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ কম। শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নয়, দেশের বিনিয়োগকারীরাও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না।
‘কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। কিন্তু অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সমস্যার মধ্যে রয়েছে। গ্রাহকরা এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে ভয় পান। আর্থিকখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হওয়ার মূল কারণ পিপলস লিজিং। এ প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম সার্বিক আর্থিকখাতের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ