বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কের বিষয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠায় অবশেষে পদত্যাগ করেছেন যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী (ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দি ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার) টিউলিপ সিদ্দিক। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে তিনি পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। খালার ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে বিনামূল্যে একাধিক সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অভিযোগের পর থেকেই তিনি চাপে ছিলেন। খবর দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, বিবিসির।
টিউলিপ সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেওয়া পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আমার প্রতি আপনি যে আস্থা প্রদর্শন করেছেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মন্ত্রীদের মানদণ্ডবিষয়ক আপনার স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি আমার স্বপ্রণোদিত আবেদন দ্রুত ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছেন এবং আমার বর্তমান ও অতীত আর্থিক এবং বাসস্থানসংক্রান্ত তথ্য বিস্তারিতভাবে শেয়ার করার সুযোগ দিয়েছেন।
আপনি অবগত আছেন, আমার অনুরোধে বিষয়টি নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করার পর, স্যার লরি নিশ্চিত করেছেন, আমি মন্ত্রিত্ববিধি ভঙ্গ করিনি। তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার মালিকানাধীন বা বসবাসকৃত সম্পত্তি বা আমার কোনো সম্পদ বৈধ উপায় ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে এসেছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
আমার পারিবারিক সম্পর্ক সর্বজনবিদিত এবং যখন আমি মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হই, তখন আমি আমার সব সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের তথ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছিলাম। কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাপক পরামর্শের পর আমাকে আমার স্বার্থপত্রে উল্লেখ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, আমার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশসংক্রান্ত বিষয় থেকে (আমার) বিরত থাকা উচিত, যাতে স্বার্থের সংঘাতের কোনো সন্দেহ না থাকে। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই, এসব বিষয়ে আমি সর্বদা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ থেকেছি এবং কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুসারে কাজ করেছি।
তবে এটি স্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক সচিব হিসাবে আমার ভূমিকা সরকারি কাজের জন্য একটি বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। আমার আনুগত্য সবসময় এই লেবার সরকার এবং তার জাতীয় পুনর্নবীকরণ ও রূপান্তরের কর্মসূচির প্রতি থাকবে।
তাই আমি আমার মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার সরকারে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি পেছনে থেকে যে কোনোভাবে সরকারকে সমর্থন করতে থাকব।
টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগপত্রের জবাবে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার লিখেছেন, প্রিয় টিউলিপ, আপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি আপনার মন্ত্রিত্বের পদত্যাগ গ্রহণ করছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে আপনার দায়িত্ব পালনের সময়কালীন আপনার প্রতিশ্রুতি ও অবদানগুলোর জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, বিশেষত ব্যাংকিং হাব চালু করা এবং আমাদের ১০০তম সাইট উদ্বোধনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করা এবং চ্যান্সেলরের প্রথম ম্যানশন হাউস বক্তৃতার সফলতায় অবদান রাখার জন্য (আপনাকে ধন্যবাদ)।
আপনার পদত্যাগ গ্রহণ করতে গিয়ে আমি স্পষ্ট করতে চাই যে, স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাস আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং আপনার আর্থিক অনিয়মের কোনো প্রমাণও নেই। স্বাধীন উপদেষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করায় এবং সত্য উদ্ঘাটনে পুরোপুরি সহযোগিতা করার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
ব্রিটেনকে পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে আমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে চলমান বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আপনি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি আমি উপলব্ধি করি এবং আপনার জন্য ভবিষ্যতে দরজা সব সময় খোলা রয়েছে, তা স্পষ্ট করতে চাই।
মন্ত্রী পর্যায়ের মানদণ্ডসংক্রান্ত স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাস বলেছেন যে, তিনি টিউলিপের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘অন্যায্যতার কোনো প্রমাণ শনাক্ত করতে পারেননি’।
‘লন্ডনের সম্পত্তির মালিকানা বা দখলের ক্ষেত্রে টিউলিপ সিদ্দিক বা তার স্বামীর নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো অনৈতিকতার প্রমাণ আমি খুঁজে পাইনি, যদিও এটি সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।’ ‘একইভাবে, আমি আওয়ামী লীগ (অথবা এর সহযোগী সংগঠন) বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত প্রশ্নবিদ্ধ সম্পত্তির মালিকানা বা দখল সম্পর্কিত কোনো অস্বাভাবিক আর্থিক ব্যবস্থার কোনো ইঙ্গিত পাইনি।’
‘এছাড়াও, আমি এমন কোনো প্রমাণ পাইনি যে টিউলিপ সিদ্দিক এবং/বা তার স্বামীর আর্থিক সম্পদ, যা আমার কাছে প্রকাশিত হয়েছে, তা বৈধ উপায় ছাড়া অন্য কোনো উপায় থেকে এসেছে।’ কিন্তু তিনি বলেন, এটা ‘দুঃখজনক’ যে টিউলিপ সিদ্দিক তার ঘনিষ্ঠ পরিবারের বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ‘সম্ভাব্য সুনাম ঝুঁকি সম্পর্কে ততটা সতর্ক ছিলেন না।
এর আগে টিউলিপ সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের মন্ত্রিপরিষদের মানদণ্ডবিষয়ক উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসকে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য আহ্বান জানান।
সিটি ও দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা টিউলিপ সিদ্দিক খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তির দেওয়া বাড়িতে বসবাস করেছেন-এমন তথ্য প্রকাশের পরপরই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মধ্য লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে একটি দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট এবং হ্যাম্পস্টেডে একটি বাড়িসহ বেশ কয়েকটি সম্পত্তি শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছ থেকে বিনামূল্যে পেয়েছেন টিউলিপ ও তার পরিবার।
যুক্তরাজ্যের একাধিক সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই টিউলিপ সিদ্দিক বেশ চাপের মধ্যে ছিলেন। দেশের আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব ছিল টিউলিপের কাঁধে।
আর তার বিরুদ্ধেই শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনের সম্পত্তি ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর পরই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। কয়েক দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল, টিউলিপ সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। অবশেষে তিনি সরে যেতে বাধ্য হলেন।
কয়েক দিন ধরেই তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি নিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছিল। সবশেষ তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানায় যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী জোট।
অর্থনৈতিক অপরাধ, অর্থ পাচার ও অবৈধ অর্থায়ন প্রতিরোধের দায়িত্ব অন্য মন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরের জন্য টিউলিপের প্রতিও আহ্বান জানায় এ জোট। এর পরই তার পদত্যাগের ঘোষণা আসে।
দি ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একজনের কাছ থেকে ফ্ল্যাট উপহার নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্ত করছেন ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর (স্ট্যান্ডার্ডস ওয়াচডগ) স্যার লরি ম্যাগনাস।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনগুলোর জোট ‘ইউকে অ্যান্টিকরাপশন কোয়ালিশন’ বলেছে, মন্ত্রীর আচরণবিধি টিউলিপ লঙ্ঘন করেছেন কিনা তা স্যার লরি খতিয়ে দেখছেন, কিন্তু মন্ত্রীর গুরুতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) রয়েছে। উল্লেখ্য, এ জোটে অক্সফাম এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো সারাবিশ্বে কার্যক্রম চালানো সংস্থা রয়েছে।
জোটের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক পিটার মুনরো বলেন, ‘মন্ত্রীদের নতুন আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাসই আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা’ এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার নির্বাচিত হয়েছে।
‘টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়েছে তা আচরণবিধির নিরিখে নতুন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসাবে হাজির হয়েছে। দুর্নীতি দমন বিশেষজ্ঞ হিসাবে এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, তার কার্যভারে এসব স্পর্শকাতর খাতের দায়িত্বে থাকা উচিত নয়।
যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী জোট বলছে, গত সপ্তাহে ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজরের তদন্ত শুরু হওয়া এবং বাংলাদেশে পৃথক তদন্তের আলোকে জোট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, বর্তমানে টিউলিপের গুরুতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
‘অর্থ পাচার বিধিমালার প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক অপরাধ মোকাবিলার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের কাঠামোর দায়িত্বে রয়েছেন আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং এই কাঠামোর অধীনেই বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শাসকের সঙ্গে তার সরাসরি পারিবারিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখা যেতে পারে।’
আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং হাসিনা প্রশাসনের সদস্য ও সংগঠনের সম্পদ জব্দের প্রশ্নে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জোট। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্য ও সহযোগীদের সম্পদের সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করতেও জোট ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
টিউলিপের স্থলাভিষিক্ত এমা রেনল্ডস : টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের পর যুক্তরাজ্যের ট্রেজারি মন্ত্রণালয়ে এসেছে পরিবর্তন। অর্থনৈতিক সচিব পদে সিদ্দিকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এমা রেনল্ডস। তিনি এর আগে ওয়ার্ক অ্যান্ড পেনশনস (ডিডব্লিউপি) মন্ত্রণালয়ের পেনশন মন্ত্রী ছিলেন এবং একইসঙ্গে জুনিয়র ট্রেজারি মন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
মঙ্গলবার টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের পরপরই এই পুনর্গঠন ঘোষণা করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। অন্যদিকে এমা রেনল্ডসের পূর্বের দায়িত্বে নিয়োগ পেয়েছেন টরস্টেন বেল। তিনি রেজলিউশন ফাউন্ডেশন থিংকট্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী এবং এড মিলিব্যান্ডের সাবেক নীতিনির্ধারণী প্রধান ছিলেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ